চাঁদ কিংবা অন্ধকার
সন্ধ্যার পরপরই আকাশে বড়সড় গোলগাল এক রূপালি চাঁদ দেখা যায়। চাঁদের সেই আলোতে গাছপালা আর মানুষের ঘরবাড়ির ওপর লেপটে থাকা রাতের অন্ধকারকে কেমন যেন নীলাভ মনে হয়। সাপ্তাহিক হাট থেকে ফিরতে ফিরতে আজ বেশ কিছুটা দেরি করে ফেলেছে সমির। নয়তো সূর্য ডুবে যাওয়ার পর
অবশিষ্ট গোধূলি আলোয় নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারে সে। কিন্তু আজই কেবল ব্যতিক্রম।
মাছের হাটে ক্রেতারা আজকাল তেমন একটা আসতে চায় না মনে হয়। ফরমালিন নাকি তারপালিন নামের এক জাতীয় বিষাক্ত রস মাছের গায়ে মাখানো থাকলে নাকি মাছ সহজে পচে না। সেই বিষাক্ত মাছ খাওয়া নাকি আরো বেশি বিপদের। ব্যাপারীদের চালাকির ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না সমির। কী প্রয়োজন এত লোক ঠকানোর? আগেকার মানুষজন আজকালকার মানুষের মতন অতটা চালাক ছিলো না বলে কি তারা খারাপ ছিলো? নাকি মানুষ বেশি চালাক হয়ে আজকাল আরো বেশি ভালো আছে? মানুষ হয়ে যদি মানুষকেই ঠকাতে হয় তাহলে মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়াটা নিরর্থক বলেই মনে হয়। বনের জীব-জানোয়ার কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার না হয় একটি উপযুক্ত কারণ আছে, মানুষ এমন করলে তার উপযুক্ত কারণ নির্ধারণ সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যার পরপরই পথঘাট জনবিরল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে হাটবন গ্রামটা পাড়ি দিতে খানিকটা অজানা শঙ্কাও মনের ভেতর ধুকপুক করে। শোনা যায় চরমপন্থিদের অনেকের সঙ্গেই এ গ্রামের মানুষদের ভালো
সখ্য আছে। বিনোদের হবু জামাই নাকি একজন চরমপন্থি। যে অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর।
বাবুল মণ্ডলের বাড়ির পেছনকার রাস্তার বাঁকে এলে অকারণেই সমিরের মাথার চুলগুলো দাঁড়িয়ে যায়। মনে হয় এলাকাটাতে অনেক অশরীরীর আনাগোনা অথবা এখানে ওখানে কারা যেন সবার অগোচরে নিজেদের মাঝে জটলা পাকাচ্ছে। আর তাই হয়তো এদিককার অন্ধকারটাকে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন আর থিকথিকে ঘন মনে হয়। মনে হয় চাঁদের উজ্জ্বল আলো থাকলেও তা যেন তেমন জোরালো নয়।
কালিতে ছাওয়া লণ্ঠনের চিমনির মতই এক ধরণের ধূসরিমায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারদিক।
হাটবারে সারাদিন মাছ বিক্রি করে ঝাঁকাটা শহিদুল্লার আড়তেই রেখে আসে সমির। কিন্তু আজ কোনো কারণে আগে
আগেই আড়ত বন্ধ করে চলে গেছে শহিদুল্লা। তা ছাড়া পরদিন সকাল মেয়েটাকে নিয়ে
ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বলে, সকাল আড়তে যেতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা না পেয়ে
শূন্য ঝাঁকাটা মাথায় করেই নিয়ে এসেছে সে।
ঘন গাছপালা আর নানা জাতের বাঁশঝাড়ের কারণে চাঁদের আলো অতটা আলোকিত করতে পারে না এদিকটা। যে কারণে অন্ধকারের দাপট এখানে বেশি। ঝাঁকা মাথায় পথ চলতে চলতে এক সময় গতি শ্লথ হয়ে আসে সমিরের। আর মিনিট বিশেক চললেই বাড়ির সীমানায় পৌঁছে যেতে পারবে সে।
অকস্মাৎ সামনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথটাকে যেন আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়। এতক্ষণ আবছা মত দেখতে পাওয়া ধুসর পথটাকেও যেন হারিয়ে ফেলে সে। দৃষ্টির সামনে কেউ যেন টানিয়ে দিয়েছে বিশাল এক কালো কাপড়ের নেকাব। এমন সময় পাশে খসখস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মৃদু ধুপধাপ শব্দও শুনতে পেলো বলে মনে হলো। কারো ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে চমকে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক ঘাড়ের ওপর কিছু একটার আঘাত টের পায় সে। সেই সঙ্গে মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে ওঠে। টলে যায় দেহের ঋজুতা। মাথার ওপর ধরে রাখা ঝাঁকাটা হঠাৎ রাস্তায় ছিটকে পড়ে গড়াতে গড়াতে কোন দিকে চলে যায় বুঝতে পারে না সে।
সারাদিনের মাছ বিক্রির লাভ আর পুঁজির টাকা মিলিয়ে তার কাছে আছে হাজার দশেকের মতো টাকা। লুঙ্গির নিচে পরা একটি ছোট্ট প্যান্টের পকেটে রুমাল দিয়ে বাঁধা আছে টাকাগুলো। আচ্ছন্নের মতো এক হাতে কাঁধের আঘাত প্রাপ্ত জায়গাটা ছুঁতে চাইলে দু পাশ থেকে কেউ যেন জাপটে ধরে তাকে। ঠিক তখনই আরো কেউ তার লুঙ্গির গিঁট টেনে খুলে ফেলে। কিন্তু চেষ্টা করেও কোনো রকম প্রতিরোধ করার শক্তি পায় না সমির।
১৩/৮/২০১১
11 Responses to চাঁদ কিংবা অন্ধকার
You must be logged in to post a comment Login