ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৪
রাত অনেকটা গভীরতার দিকে এগিয়ে গেলে বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকলে হোসেন মৃধা ঘুমিয়ে পড়লো কি না পরখ করতে চান্দভানু আস্তে করে হোসেন মৃধার গায়ে ঠেলা দিতেই হোসেন মৃধা পাশ ফিরে বললো, সমস্যা কি? ঘুমাস নাই?
চান্দভানুর ঘুম কি আর আসে? রাতের খাওয়া সেরে যে সে বের হয়েছিলো তারপর আর ঘরে আসেনি। প্রতিদিন বাংলা ঘরে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একবার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে, মা, দরজা ভালামতন লাগাইছ তো?
কিন্তু আজ এতটা সময় পেরিয়ে গেল এখনও হাসন আলির কন্ঠস্বর শুনতে পায়নি সে। অন্যান্য দিন এ সময়ের অনেক আগেই সে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটা এমনই এক অভ্যাস তৈরী করে দিয়েছে যা এত কাল খেয়াল হয়নি। আর আজই প্রথম তার মনে হলো কী একটা জরুরি কাজ যেন বাকি রয়ে গেছে। আর তা অসম্পূর্ণ থাকার ফলে ভেতরে ভেতরে বেশ ছটফট করছিল সে। এপাশ ও পাশ করলেও আসলে সে হাসন আলির অপেক্ষা করছিলো। শেষটায় মনের ভেতর কু ডাকতে আরম্ভ করলে সে হোসেন মৃধাকে ঠেলা দিতে বাধ্য হয় যেন। অথবা এমনও হতে পারে যে, মানসিক অস্থিরতার কারণে নিজের অজান্তেই তার হাত উঠে গিয়েছিলো।
হোসেন মৃধার প্রশ্নের উত্তর হয়তো দিতে পারতো সে। কিন্তু সে কথা না বলে খানিকটা সিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, হাসন আলি যে অহনও আইলো না!
আলিমের লগে গেছে।
হোসেন মৃধার সোজাসাপটা জবাব পেয়ে চান্দভানুর যেন হঠাৎ করেই অভিমান চাড়া দিয়ে ওঠে। কেমন নাকি সুরে আবার বলে, এই কথাডা কি আমারে আগে কইতে পারতেন না? চিন্তায় আমার মাথা গরম হওনের বাকি আছে।
আলিমের লগে তো পোলাডা আরো অনেকবার গেছে নাকি? এত চিন্তার কি আছে? তা ছাড়া আলিমের বাইত্যেও তো হ্যায় কত রাইত ঘুমাইছে। এমন না যে এইডা নতুন কোনো ঘটনা!
স্ত্রীকে প্রবোধ দিতে পারলেও নিজের ভেতরকার অস্থিরতা সে চাপা দেবে কেমন করে? যদিও সে স্থির হয়ে বিছানায় পড়েছিলো, তবুও একরত্তি ঘুম তার আসেনি। হয়তো সে ঘুমুতেও পারবে না বাকি দিনগুলো। ছেলেটা যতদিন ভালোয় ভালোয় ফিরে না আসছে ততদিন সে নিজেই কি শান্তি পাবে পলকের জন্য? যদিও দেশের স্বার্থে প্রতিটি দেশ প্রেমিক পিতা-মাতার উচিত নিজের সক্ষম ছেলেটিকে দেশ রক্ষার কাজে হাসিমুখে এগিয়ে দেওয়া। তবুও কথাটি অন্যের বেলা যতটা জোর দিয়ে বলা যায় নিজের বেলা যেন ততটা জোর খাটে না। মনের কোথাও যেন একটি হাহাকার, অনিশ্চয়তা বা ভয় কিছুটা হলেও চিনচিন করতে থাকে। তারপরও হোসেন মৃধা মনেমনে সান্ত্বনা খুঁজতে চেষ্টা করে যে, ছেলে তো গেছে একটি বড় কাজে শরিক হতে। কোথায় যেন একবার সে শুনেছিলো যে, ব্যক্তির চেয়ে পরিবার বড়। তার চেয়ে বড় সমাজ। আর সব কিছুর উর্ধে হচ্ছে দেশ। যার দেশ নেই তার সব কিছু থেকেও নেই। একটি মানুষের প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে তার দেশ। হোসেন মৃধার মনে এই সান্ত্বনা যে, সন্তানের চেয়ে দেশ বড়।
চান্দভানু বললো, বাইরে কারে জানি কইতে হুনলাম, যোয়ান মরদ পোলাগো সবতেই নাহি মতিভাইয়ের দলে যোগ দেওন লাগবো?
হোসেন মৃধা খুব দ্রুত ভেবে ঠিক করে যে এখনই চান্দভানুকে বাগ মানাতে না পারলে পরে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না। তাই সে বলে উঠলো, আলিম কইতাছিলো গ্যারামে গ্যারামে মিলিটারি আইবো। বড় টাউন-বন্দরে পাইক্যারা অনেক মানুষ মারছে। ঘরবাড়িতে আগুন দিছে। সবতেরেই হুনছি জোর কইরা মিলিটারিতে ঢুকাইবো। নাম দিবো রাজাকার। কিন্তু পাইক্যাগো দলে গিয়া মরনের থাইক্যা মুক্তি হইয়া মারা গেলে মনে করি শা কপাল। মনেরে বুঝ দেওন যাইবো যে, দেশের লাইগ্যা জান দিছে। রেডিওতে কইতে হুনস নাই দেশটাও আমাগো মা? যেই মাটিতে পয়দা হইছি হেই মাটিও আমাগ মায়ের মতন।
চান্দভানু হঠাৎ করেই যেন গম্ভীর হয়ে পড়ে। ভেতরে ভেতরে যেন কোনো একটা বিষয় নিয়ে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। হাঠাৎ করেই সে উঠে বসে দুহাতে হোসেন মৃধার বাহু চেপে ধরে বলে উঠলো, যারা মিলিটারিতে না যাইবো, রাজাকার হইতে যাগো মনে না চাইবো তাগো কি হইবো?
হোসেন মৃধা চান্দভানুর একটি হাত ধরে বললো, আলিম তো হাসনরে কইতাছিলো যে, যারা পাইক্যাগো কথা হুনবো না হ্যাগোরে গুল্লি দিয়া মারবো।
হোসেন মৃধার কথা শেষ না হতেই চান্দভানুর পুরো শরীর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। হাঠাৎ করেই সে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে উঠলো, তাইলে আপনে বিয়ানে ফজরের সময়ই আলিমগ বাইত্যে যাইবেন। হ্যাগোরে কইয়েন, তারা জানি অন্য কোনোখানে পলাইয়া যায়।
হোসেন মৃধারও কম খারাপ লাগছিলো না। তবে বেশি খারাপ লাগছিলো চান্দভানুর কান্না দেখে। বিয়ের পর এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে হোসেন মৃধার মনে পড়ে না যে, সে এমন কোনো কাজ করেছে যে কারণে কাঁদতে হয়েছে চান্দভানুর। এমনিতেও চান্দভানুকে সে তেমন একটা কাঁদতে দেখেনি। একবার যখন তার মা মারা গেলেন সেবারই কেঁদেছিলো বেশি। ছোটবেলা পিতৃহারা হয়েছিলো বলে মায়ের জন্যই তার দুঃখবোধ হয়তো বেশি ছিলো। তারপর আরো দুবার তাকে কাঁদতে দেখেছিলো যখন কলেরায় তার নিজের বাবা মা একই দিনে মারা গেলেন। চান্দভানুর শ্বশুর-শাশুড়ি হিসেবে দুজনই হয়তো ভালো ছিলেন। তা ছাড়া চান্দভানুকে দুজনই খুব ভালোবাসতেন। চান্দভানুর আচার আচরণেও তা প্রকাশ পেতো। হাতে গোণা তিনবারই কাঁদতে দেখা গেছে তাকে। তাই এখন স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে হোসেন মৃধার বুকের ভেতর যেন গভীর বেদনা মোচড় দিয়ে উঠতে থাকে। সে উঠে বসে বলে, তুই কান্দস ক্যান? আর তর পোলা পলাইয়া গেলেই কি বিপদ শেষ হইয়া গেল? আস্তে আস্তে সব গ্যারামে মিলিটারি আইবো। তোমার মতি ভাইয়ের মত কিছু বদ মানুষ সব গ্যারামেই আছে। তারাই তাগরে বিপদে ফালাইবো আরো বেশি।
চান্দভানু হঠাৎ করেই যেন কান্না থামায়। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে, তাইলে চলেন আমরাও যুদ্ধে যাই। ত্যাল্লাচোরার মতন মরনের থাইক্যা যুদ্ধ কইরা মরা অনেক সর্মানের।
হোসেন মৃধার বুক থেকে যেন বিশাল এক পাথর নামে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে যেন হালকা হয় কিছুটা। তারপর পরম মমতায় অন্ধকারেই জড়িয়ে ধরে চান্দভানুকে। বলে, চাইরো দিগে যা হোনা যাইতাছে বেশি বিপদ মাইয়া মানষ্যের। পুরুষগুলারে তো গুল্লি দিয়া মাইরা ফালায় চলে। কিন্তু মাইয়া মানুষরে মারে না। হ্যাগোরে পাইলে ধইরা নিয়া যায়। বেইজ্জতি করে। পরতেক দিন কয়েকবার মরনের থাইক্যা যুদ্ধ কইরা গুল্লি খাইয়া মরাও মনে করি ইজ্জতের।
ব্যাপারটা যেন এতক্ষণে হৃদয়ঙ্গম হয় চান্দভানুর। বলে, তাইলে জুলেখারে কই রাইখ্যা যামু?
হোসেন মৃধা এখন এসব নিয়ে আর ভাবে না। প্রাথমিক ধাক্কা পার হওয়া গেছে। এমনিতেই হাসন আলি যাওয়ার পর থেকেই সে খুব দুর্ভাবনায় ছিলো চান্দভানুকে নিয়ে। একজন মায়ের মনকে প্রবোধ দেওয়া আরো বড় মিথ্যেবাদীর পক্ষেও হয়তো সম্ভব নয়।
রাতের গভীরতা পরিমাপ করার কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের কাছে। তাই সে গভীরতা মাপার একমাত্র উপায় হচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর চিৎকারের তীব্রতা। রাত যত গভীর তাদের চিৎকারও ততটা তীব্র।
বুকের ভেতর লেপ্টে থাকা চান্দভানুর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিলে দীর্ঘদিন পর যেন পরিচিত একটি সুবাস আচ্ছন্ন করে দিতে থাকে হোসেন মৃধাকে। কত রাত সে এভাবেই বুঁদ হয়ে থেকেছে চান্দভানুর দেহের সুবাসে। ঠিক যেন ছাতিম ফুলের ঘ্রাণের মত নেশা জাগায়। এ নিয়ে প্রথম প্রথম বেশ বিব্রত হতো চান্দভানু। শরীর থেকে সুবাস আসে ব্যাপারটা যেন তার বোধগম্য হতো না। ঠাট্টা ভেবে কষ্ট পেতো। কিন্তু দিনে দিনে ব্যাপারটাও যেন সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। আর ঠিক একই ভাবে নিজেও শিখেছে হোসেন মৃধার শরীরে যেন লেপ্টে আছে সেদ্ধ ধানের ঘ্রাণ। পারস্পরিক এ আবিষ্কার যেন দুজনকেই দুজনের প্রতি বিপুল মাদকতায় টানে। আর সে কারণেই যেন প্রায় ভুলে যেতে বসা শরীর সম্পর্কে ফের আগ্রহী হয়ে ওঠে দুজনেই।
(চলবে)
আগের পর্ব
13 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৪
You must be logged in to post a comment Login