জুলিয়ান সিদ্দিকী

প্রমিত বাংলা বিষয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলাপ

প্রমিত বাংলা বিষয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলাপ
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

স্কুলের ব্যাকরণ বইয়ে যখন পড়ি ভাষা কাহাকে বলে? বাংলা ভাষা কত প্রকার ও কি কি? তখনই জানতে পাই বাংলা ভাষা দু ধরনের। সাধু ও চলিত। তবে বড় হতে হতে জানতে পেয়েছিলাম আঞ্চলিক আর গুরুচণ্ডালী বলেও বাংলা ভাষার আরো দুটো প্রতিরূপ রয়েছে। তো যাই হোক, আমি যে বিষয়টি নিয়ে বলতে চাচ্ছি তা হলো বাংলাভাষার প্রমিত রূপ সম্পর্কে। স্কুল থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অবধি প্রশ্নপত্রে লেখা থাকতো সাধু অথবা চলিত ভাষায় উত্তর লিখতে হবে। তারপর আস্তে ধীরে সর্বত্র চলিত ভাষাটির প্রয়োগ হয়ে উঠলো গুরুত্বপূর্ণ। সাধু ভাষা হয়ে উঠলো সেকেলে অথবা শরৎচন্দ্রের ভাষা। এখন সর্বত্রই চলিত ভাষার জয়-জয়কার হলেও ইদানীং বাংলা ব্লগের ভয়াবহ রকমের জনপ্রিয়তার কারণে এবং ব্লগারদের বিচিত্র ধরনের শব্দ ব্যবহারের ফলেই হয়তো আমাদের বাংলা ভাষার রক্ষাকর্তারা খানিকটা তেড়ে উঠে বললেন, বাংলা ভাষার চরিত্র হনন চলবে না। বিশেষ করে টেলিভিশনের নাটকে অ-চলিত ভাষার সংলাপ ব্যবহারও হয়তো বিজ্ঞজনদের শঙ্কিত করে তুলেছে। এখন  স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে চলিত ভাষা কোনটা বা কাকে বলে?

ছোটবেলায় বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে জেনেছি যে, ভারতের ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাষা, তথা কলকাতা অঞ্চলের বাংলাভাষী লোকদের মুখে প্রচলিত কথ্য ভাষাটিই হচ্ছে বাংলা ভাষার কথ্য বা চলিত রূপ। ভাগীরথী নদীর তীরে বা ভারতের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা অঞ্চলের ভাষাটিই কেন বাংলাদেশের চলিত ভাষা হিসেবে পরিগণিত হবে? বা কেনই বা একে চলিত বা লেখ্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে?

বাংলার দুটি অংশ। পশ্চিম বাংলা আর পূর্ব বাংলা। পশ্চিম বাংলার মানুষরা পূর্ব-বাংলার লোকদের বলতো ঘটি বা বাঙাল। যাদের মুখের ভাষা তাদের মত অতটা পরিশীলিত নয়। তারা কেমন করে যেন কথা বলে। চাল কে বলে চাউল। মাটিকে বলে মাডি। টাকাকে বলে ট্যাহা। খেয়েছি না বলে বলে খাইসি। তা হলে না বলে বলে তাইলে। এমনি নানা ধরনের বিচিত্র আর নিজস্ব উদ্ভট শব্দে সমৃদ্ধ পূর্ব বাংলার ভাষা।

দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী নাটকে একটি চরিত্রের মুখে আক্ষেপ শুনতে পাই, যে কলকাতায় গিয়ে বাবুদের মত অনেক কিছুই করেছে, এমনকি “মাগীর বাড়ি গেচি, ব্রান্ডি খাইচি, তবু কলকাত্তার মত হবার পারলাম না।“

এই যে কতিপয় ঘটির কলকাত্তার মতো হতে চাওয়া তা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। পূর্ব-বাংলার মানুষদের প্রতি আর তাদের ভাষার প্রতি যে একটি অবজ্ঞার ভাব ফুটে উঠতো কলকাত্তার মানুষদের তা থেকেই হয়তো কিছু ঘটির সে চেষ্টা ছিলো, যা সফল হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন কলকাত্তার ভাষা আমাদের বাঙ্গালদের জন্য চলিত ভাষা হয়ে উঠতে চাচ্ছে বারবার?

উত্তরটি খুব একটা জটিল হয়তো নয়। প্রথমে স্মরণ করা যেতে পারে কলকাতা হিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির কথা। তারপর বলা যেতে পারে যে, এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলেন একটি বাংলা অভিধান প্রণয়ন করতে। দীর্ঘকাল সেই অভিধানের প্রভাব এবং পরবর্তী বাংলা অভিধান সমূহ একই অভিধানকে অনুসরণ করাই হয়তো মূল কারণ। বৃটিশ রাজত্বে ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা কথনে পারদর্শী করে তুলতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং উইলিয়াম কেরি সাহেবের বাংলা চর্চা সহ তার প্রচলন থেকে শুরু করে তখন বাংলা শিক্ষা মুলত কলকাতা কেন্দ্রিকই ছিলো।

সে কালে শিক্ষার জন্য ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে হতো কলকাতা। সেখানে যেয়ে তারা শিক্ষিত হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার কথ্য বা চলিত ভাষার প্রেমে পড়ে যেতেন। সে ভাষাতেই হয়ে উঠতেন অভ্যস্ত। যে কারণে তাদের কাছে সেই ভাষাটিকেই মনে হয়েছে আদর্শ। তা ছাড়া ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত উপ-মহাদেশটি বৃটিশ আর এ দেশীয় ক্ষমতালিপ্সু দু মহারথী নেহেরু এবং জিন্না দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধূয়া তুলে, হিন্দু-মুসলিমের জন্য আলাদা রাষ্ট্র বানাতে ভারত-পাকিস্তানে ভাগ করতে তৎপর হলেন। হিন্দুদের মুখে ধ্বণিত হলো, “হিন্দ-হিন্দু- হিন্দুস্তান, মুসলিম ভাগো পাকিস্তান।” অথবা মুসলিমদের মুখে, “হাথো মে বিডি মুমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান!”

অই দুই লোভী পুরুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে গিয়ে দেখলেন না যে, দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঘর-বাড়ি জমি-জমা, উঠোনই কেবল ভাগ হচ্ছে না, খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে মানুষের হৃদয় আর ভালোবাসাও। সেই সুবাদে পাঞ্জাব, কাশ্মীর আর বাংলার বুক বরাবর চিরে দু ভাগ হয়ে গেলেও নেহেরু আর জিন্না হয়তো সুখি হয়েছিলেন- দোর্দণ্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়ে।

সেই সময় দেশ ভাগের ফলে পশ্চিম বাংলা ভারতে আর পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলে অনেক হিন্দু পুর্ব বাংলা ছেড়ে চলে গেলেন ভারতের পশ্চিম বঙ্গে। তেমনি পশ্চিম বঙ্গের অনেক মুসলিমও চলে এলেন পূর্ব বঙ্গে। কিন্তু ভারত হতে পারলো না শতভাগ হিন্দুস্তান, তেমনি পাকিস্তানও পারলো না শতভাগ মুসলমানের দেশ। দেশ ত্যাগীদের সেই দলে অনেক অ-শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের পাশাপাশি বেশ কিছু শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানও ছিলেন। সেই শিক্ষিত বাঙ্গালি মুসলমানরা ভারত ত্যাগের সময় সঙ্গে করে যা আনতে পেরেছিলেন, তার মাঝে আরেকটি প্রধান ব্যাপার ছিলো কলকাতার পরিশিলীত বাংলা ভাষাটি। সেই মহাজনরা পাকিস্তানের বিভিন্ন উচ্চ-পদে আসীন হলেন। আসীন হলেন শিক্ষা বিভাগেও। মূলত: তখন থেকেই ভারত ত্যাগী মুসলিম পণ্ডিতরা পুর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাটির রক্ষণাবেক্ষণ আর পরিমার্জনেরও অধিকার পেয়ে যান। ফলে, কলকাতার শিক্ষা কালীন অবস্থা থেকে বুকে লালিত এতদিনকার পরিচ্ছন্ন আর পরিশিলীত বাংলা ভাষাটির বীজ বপনের জন্যও তৎপর হলেন। চাষা-ভূষোর ভাষায় কি শিক্ষিত সমাজের আলাপচারিতা জমে? সে ভাষায় কি গ্রন্থ রচনা চলে? কাজেই পূর্ব বাংলার চাষা-ভূষোদের মতোই তাদের ভাষাটিও পড়ে রইলো ক্ষেতের পাশে, বাড়ির উঠোনে, হাটে-বাজারে, স্টেশনে। কিন্তু সে প্রবেশিধাকার পেলো না শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে আধিপত্য পশ্চিম বাংলার সেই মার্জিত ভাষাটি, যা কলকাতা অঞ্চলের ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিলো।

সেই ভাষার স্বার্থেই ফের পাকিস্তান ভাগ হলো আবার। পাকিস্তান বা ভারতের মত কেউ নিজের  মনোমতো ম্যাপের উপর দিয়ে পেন্সিলের দাগে আলাদা করে দিয়ে যায়নি বাংলাদেশকে। অনেক প্রাণ আর মর্যাদার বলীদানের ফসল এই বাংলাদেশ। আর স্বাধীনতার পর কালে কালে বাংলা একাডেমীও সে ভাষাটির রক্ষাকর্তা হয়ে উঠলো। গ্রন্থ-প্রনয়ন, পত্রিকা প্রকাশন, সব ক্ষেত্রে কলকাতার ভাষাটি প্রতিনিধি হলেও স্বদেশের মানুষের মুখের ভাষাটি রয়ে গেল অবহেলিত। এখন চারদিকে শোরগোল হচ্ছে, বাংলাভাষা শেষ হয়ে গেল। একে রক্ষা করতেই হবে। বাংলাভাষার একটা প্রমিত রূপ না দিতে পারলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমদানী করা কূলীন ভাষাটি হারিয়ে যাবে বর্তমানকালের স্বেচ্ছাচারী ভাষাটির স্তুপের আড়ালে। কাজেই একে রক্ষা করতে না পারলে পূর্ব পুরুষের মান আর থাকে না। কিন্তু প্রমিত বা মান বা স্ট্যান্ডার্ড বাংলাভাষার কথা শুনে আসছি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই হয়তো। কিন্তু আজো চোখে দেখলাম না। বাংলা একাডেমী আর বিজ্ঞজনেরা বলছেন সর্বত্র প্রমিত বাংলা চালুর কথা। অথচ বাংলার প্রমিত রূপটাই যে কী তেমন নির্দিষ্ট কিছু আজো বাংলা একাডেমী বা ভিন্ন কেউ আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারলেন না।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


28 Responses to প্রমিত বাংলা বিষয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলাপ

You must be logged in to post a comment Login