জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কেউ যদি তার পছন্দের জিনিসটি পানিতে ছুঁড়ে ফেলে কিংবা ভেঙেচুরে গুঁড়োগুঁড়ো করে ফেলে, তাহলে হয়তো কারো কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তা যদি হয় পরিবারের সবার আদরের বা প্রিয় জিনিস, তাহলে হয়তো অনেক কিছুই বলার থাকে। এমন কি প্রতিরোধ কিংবা প্রতিরোধের অধিকারও হয়তো থাকে। তেমনি সুরানন্দী গ্রামের হোসেন মৃধার পরিবারে সবারই প্রিয় জিনিসটি হচ্ছে একটি ফিলিপস তিনব্যান্ড রেডিও। বেশ কিছুটা পুরোনো হলেও এটিকে তার পারিবারিক গৌরব বললেও বাগাড়ম্বর বলে মনে হবে না হয়তো। কেন না আশপাশের দু’চার গ্রামের ভেতর কারো তিনব্যান্ড রেডিও নেই। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রাতের খাওয়া শেষ করেই লোকজন আস্তে-ধীরে এসে জড়ো হতে থাকে হোসেন মৃধার বাংলা ঘরের সামনে। তা ছাড়া বাংলা ঘরটির একপাশে বেশ কিছু খড় স্তুপ করে রাখা আছে, যাতে লোকজন এসে নিজের সুবিধা মত খড় বিছিয়ে আয়েশ করে বসতে পারে।

কোথাও একটুকরো গুড় পড়ে থাকলে যেমন প্রথম কোনো একটি পিঁপড়ে এসে উপস্থিত হয়। তারপর একে একে আরো পিঁপড়ে এসে গুড়ের টুকরোটিকে সব দিক থেকেই ঘিরে ধরার ফলে সেখানে গুড়ের অস্তিত্ব আর চোখে পড়ে না, দেখা যায় কেবল পিঁপড়ে আর পিঁপড়ে। তেমনি হোসেন মৃধার বাংলা ঘরের সামনে প্রথম এসে উপস্থিত হয় গহর মাঝি। প্রতিদিনকার মত এসেই সে হাঁক দেয়, মিরধা কি বাড়ি আছো?

কোনো কোনোদিন মৃধা নিজেই গলা চড়িয়ে জানান দেয়, বও মাঝি! নয়তো হোসেন মৃধা উপস্থিত না থাকলে তার ছেলে হাসন আলি ঘর থেকে জানান দেয়, বয়েন চাচা!

তারপর গহর মাঝি খানিকটা খড় টেনে নিয়ে বসে পড়বে নিজের পছন্দ মত কোনো জায়গায়। এভাবে লোকজন নিজের সুবিধা মত বসে পড়লে হাসন আলি অথবা হোসেন মৃধা রেওটাকে চালু করে বাজাতে বাজাতে এসে বসে পড়বে সবার মাঝখানে। রেডিটাকে কেন্দ্র করে লোকজন আরো খানিকটা এগিয়ে আসবে গোল হয়ে। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আজকের লোম হর্ষক ঘটনাগুলো।

খানিকটা দূর থেকে তাকালে উপস্থিত লোকজনের হাতের হ্যারিকেন কিংবা লণ্ঠনের আলোয় দেখা যাবে মানুষের মাথাগুলো। কারো মাথায় কালো মিশমিশে চুল, কারো বা সাদা ধবধবে নয়তো আধাপাকা চুল। কারো মাথায় মাঝামাঝি একটি চুলও অবশিষ্ট নেই। কারো কারো মাথায় লুঙ্গি অথবা গামছা বেঁধে রাখা আছে পাগড়ির মত করে। সবগুলো মাথাই যেন একটি আরেকটি মাথার সঙ্গে খানিকটা কাৎ হয়ে বা ঝুঁকে লেগে আছে। যেন সামনের মাথাটির কারণে পেছনের মাথাটি আরো খানিকটা এগোতে পারছে না। আর এভাবেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর লোকজন বিবিসি, আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শুনে আরেকটি অনিশ্চিত রাত্রিকে বরণ করে নিতে যার যেমন ফিরে যায়।

সুউচ্চ শব্দের কারণে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আলতা বেড়ার কাছে কান পেতে দাঁড়ায় হোসেন মৃধার স্ত্রী চাঁদভানু। তার পেছন পেছন আসে কন্যা জুলেখাও।মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধের সংবাদে তারাও কখনো হর্ষোৎফুল্ল ওঠে। কখনো বা বিষাদের কালিমায় ছেয়ে যায় তাদের চোখের তারা। তখন তাদের গায়ে মশার হূল কতটুকু বিদ্ধ হচ্ছে বা কতগুলো মাশা তাদের হাত-পা আর মুখের উম্মুক্ত অংশে হূল ফুটিয়ে ক্রমাগত শূষে যাচ্ছে রক্ত সে বোধ বিবেচনা থাকে না। মনের আনাচে কানাচে কেবল একটি হাহাকার ধ্বণি দাপাদাপি করে তাদের বোধকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।

এমনি হর্ষ-বিষাদের প্রাত্যহিক সংবাদ নিয়ে আসতো যে রেডিও সেটিই অকস্মাৎ একদিন তাদের মনোবেদনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

চাঁদভানুর সৎভাই পাঁচগ্রাম দূর সিদ্ধেশ্বরী থেকে একদিন বোনের বাড়ি এলেন বেড়াতে। উদ্দেশ্য, গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটিকে জোরদার করে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় দেশ প্রেম আর ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত করা। আশ-পাশের গ্রামে এখনো কোনো মুক্তি বা পাক বাহিনীর সদস্যের পাদস্পর্শ ঘটেনি। এমনকি পালিয়ে গিয়ে কেউ মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে তেমন কোনো সংবাদও কর্ণগোচর হয়নি। তাই সময় থাকতেই আটঘাট বেঁধে না রাখলে সময়ে তা পস্তানোর কারণও হয়ে উঠতে পারে। তার ওস্তাদ মাওলানা মান্নান দেওবন্দি সংবাদ পাঠিয়েছেন যে, দিন কয়েকের ভেতর তার নেতৃত্বে একটি শান্তি কমিটি করে সদস্যদের নামের তালিকা যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর ঘরে ঘরে কাফের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন কিছু তেজী যুবকের। যাদের হুঙ্কারে স্তিমিত হয়ে পড়বে মালাউন আর কাফেরদের সহযোগী যারা অখণ্ড পাকিস্তানকে ভেঙে তছনছ কারার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মালাউন শেখ মুজিবের মত যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় বিভোর।

মতিউর রহমান ভেবেছিলেন যে, সন্ধ্যার দিকে যাত্রা আরম্ভ করলে ভরা পূর্ণিমার আলো গায়ে মাখতে মাখতে পৌঁছে যাবেন ছোট মায়ের ঘরের বোন চাঁদভানুর বাড়ি। কিন্তু বর্ষাকাল বলে একা নৌকা চালিয়ে যাওয়া তার একার পক্ষে খুব বেশি কষ্টসাধ্য। আর তাই ব্যাপারটিকে খানিক লঘু করতেই তিনি শরণাপন্ন হলে কারি দেলোয়ার হোসেনের মুনিষ আজমের। তিনি সন্ধ্যার পরপরই আজমকে ডেকে বললেন, চলরে আজম, চান্দের বাড়িত থাইক্যা ঘুইরা আসি।

আজম মতিউর রহমানের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে বলে, ইট্টু খাড়ান! গঞ্জি আর গামছাডা লইয়া লই!

এর আগে সে মতিউর রহমানকে নিয়ে সুরানন্দী মৃধা বাড়িতে গিয়েছিলো। এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলো জুলেখার মুখের একাংশ। অকস্মাৎ বিদ্যুৎ চমকালে অন্ধকারে যেমন কিছু ঠাহর করা যায় না, তেমনি কিছুক্ষণের জন্য তার চোখেও বিদ্যুতের ঝলকানি লেগে তার দৃষ্টিপথও বিবশ হয়ে গিয়েছিলো। আহা! যেন এখনও যেন বিদ্যুল্লতার মত তার মননে ধাধা লাগিয়ে রেখেছে জুলেখা।

সে একলাফে ঘুরে ঢুকে গেঞ্জি আর গামছা নিয়ে বেরিয়ে এসে বলে, চলেন যাই!

কারিরে জানাইয়া আয় যে, তুই আমার লগে যাইতাছস!

সে ফের বাড়িত ভেতর ছুটে গিয়েই পলকে যেন ফিরে এসে দাঁড়ায় মতিউর রহমানের সামনে। তারপর বলে, নৌকা কোহানে?

বাড়ির ঘাটায় আছে।

চলেন বড় মিয়া! বলেই মতিউর রহমানের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় আজম। ঘুর পথে মতিউর রহমানের বাড়ির সামনে রাখা নৌকায় চড়ে লগি হাতে অপেক্ষা করে সে। তারপর মতিউর রহমানকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো, বুড়িচক দিয়া যাই। সময় কম লাগবো!

নৌকায় চড়ে পাটাতনের ওপর বিছিয়ে রাখা হোগলায় নিজের কাধেঁর রুমালটা বিছিয়ে তার ওপর আয়েশ করে বসে মতিউর রহমান জানালেন, তর যেমনে ভালো অয় হেমনেই যা!

আজম একবার চোখ বন্ধ করে মনেমনে যেন জুলেখাকে দেখার মুহূর্তের বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ অনুভব করে খানিকটা কেঁপে উঠলো যেন। যে কারণে তার পা হড়কে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো পানিতে। লগিতে ভর দিয়ে নিজকে সামলে নিয়ে নৌকা ঘুরায় সে। তারপর ফের নৌকা সোজা করে বুড়িচকের দিকে মুখ করে লগিতে ভর দিয়ে এগোয়।

নৌকা তো মৃত কাঠের নৌকা। তার যদি ভাষা থাকতো তাহলে অবশ্যই আজমকে বলতো খানিকটা রয়েসয়ে চালাতে। কিন্তু তা না পেরে বুঝি মুখের কাছে অনবরত ফেনা তুলতে তুলতে পানি কেটে এগিয়ে যাওয়ার সময় বোবা আক্রোশে ফুঁসছে। আর পানি কাটার সেই বিচিত্র শব্দে যেন উৎসাহ দ্বিগুণিত হতে থাকে আজমের।

মতিউর রহমান মনেমনে আজমের প্রশংসা করেন। এমন বাঘের মত যার গায়ের শক্তি তেমন ছেলেদেরই তার হিজবুল্লা দলে প্রয়োজন। চান্দভানুর ছেলে হাসণ আলিও দেহে কম শক্তি ধরে না। একবার এ দুজনকে কুস্তি লড়তে দিয়ে শক্তি পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। তবে নিজের সতালো বোন চান্দভানুর ছেলেকে খুব বেশি শক্তিশালী ভাবতে পারেন না তিনি। হাসন আলি শহরে থেকে লেখাপড়া করছে। শরীর মনের যাবতীয় শক্তি ব্যয় করে ফেলছে লেখাপড়ার পেছনেই। অন্যদিকে উদয়াস্ত খেটেখুটে আজমের গায়ে সঞ্চিত হয়েছে বাঘের মত শক্তি। সে তুলনায় হাসন আলি নির্ঘাৎ ছাগলের বাচ্চার মতই।

আকাশের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমার গোল বড় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আপন মনেই একবার হাসলেন মতিউর রহমান। তারপর আজমের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন চিত্তে বললেন, আর কতক্ষণ রে?

লগিতে দ্বিগুণ শক্তিতে ভর দিয়ে আজম জানালো, আর বেশি দিরং নাই!

মতিউর রহমান দেখতে পেলেন, সুরানন্দী গ্রামের জোড়া তালগাছ আবছা হলেও দৃষ্টি সীমায় চলে এসেছে। ভগ্নিপতি হোসেন মৃধার কথা ভাবতেই মনের ভেতর আরো প্রসন্নতা অনুভব করেন। চান্দের স্বামী হোসেন মৃধা খুবই ভালো মানুষ। মতিউর রহমানকে যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। মানেও খুব। শান্তি কমিটিতে তাকে সুরানন্দী গ্রামের সভাপতি বানানোর ইচ্ছে তার। আর হাসন আলিকে হিজবুল্লাহর প্রধান। যাকে যেখানে মানায়।

ভাবতে ভাবতে মৃধা বাড়ির দিকে চোখ পড়তেই মতিউর রহমানের কপালে ভাঁজ ফুটে উঠতে দেরি হয় না। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় আবছায়া দেখতে পান মৃধা বাড়ির সামনে অনেক নৌকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি নৌকায় যেন আরো অনেক বেশি চড়নদার। তার মনে হলো যে, লোকজন সব হোসেন মৃধার কাছেই এসেছিলো। কেন এসেছিলো? হোসেন মৃধা কি গোপনে গোপনে পাকিস্তান ভাঙার দলে? নয়তো এত মানুষ কেন তার বাড়ির পাশে? তাও দিনের বেলা না হয়ে রাতে?

মতিউর রহমান আজমকে আরো জোরে নৌকা চালানোর কথা বললেও নৌকা ততটা এগোয় না। কারণ বাঘের বা অসুরের শক্তি গায়ে থাকলেও একটানা নৌকা বাইলে সে শক্তির কতটুকুই বা অবশিষ্ট থাকে! ব্যয় করলে সব কিছুই কমে। তার মাঝে শক্তিও একটি।

আজমের শক্তিও ফুরিয়ে এসেছিলো। পুরো শরীর কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। বিশেষ করে হাত দুটো প্রায় ভেঙে আসছিলো। তবুও সে লগিতে ভর দিয়ে নৌকাটাকে ঠেলে চলেছে কেবল মনের জোরে। যে স্ফুলিঙ্গ তার চোখে লেগে আছে সে স্ফুলিঙ্গের উৎস জুলেখাকে যদি একবার দু’চোখ ভরে দেখতে পায় সেই দুরাশা বুকে ধারন করেই তার এতটা পথ ছুটে আসা। আর মৃধা বাড়ির সামনেই নৌকা থামিয়ে মতিউর রহমানের পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকলেও সেই বিদ্যুল্লতার অধিকারিনী জুলেখার দেখা সে পায় না।

ভেতর বাড়িতে মতিউর রহমান ঢুকে পড়লেও কী মনে করে আজম সে ঘরের দরজার সামনে আধো অন্ধকারেই দাড়িয়েঁ থাকে ভূতের মত। বইরে দাঁড়িয়ে জুলেখার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পেলেও একবারের জন্যও জুলেখা তার দৃষ্টিগোচর হয় না। অকস্মাৎ মরিয়া হয়েই যেন সে ভেতর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। হোসেন মৃধা তাকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠে বললো, তুই কেরে?

মতিউর রহমান তাকে দেখতে পেয়ে কণ্ঠস্বরে যুগপৎ প্রশ্রয় এবং তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে উঠলেন, তুই আবার ক্যান এহানে আইতে গেলি?

পানি! তিয়াসে আমার বুক ফাইট্যা যাইতাছে!

কিন্তু এ কথা বললেও অন্দর থেকে তার জন্য কেউ পানি নিয়ে এগিয়ে আসে না।

হোসেন মৃধা ঘরের মাঝামাঝি জলচৌকিতে রাখা একটি পিতলের জগ আর ফুলতোলা কাচের গ্লাস দেখিয়ে দিলে আজম সেখান থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পরপর দুগ্লাস পানি খেয়ে ফেললেও তার বুক যেন শীতলতার পরশ পায় না। বরঞ্চ তৃষ্ণা যেন দ্বিগুণিত হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ঘামের বিন্দুগুলোকে এক একটি স্রোতধারার আকৃতি দেয়। সে কেমন ছটফট করতে করতে ফের বাইরে এসে আধো অন্ধকারে দাঁড়ায়।

তার একবার খুবই ইচ্ছে হয় যে জানালার ফাঁক গলে চুইয়ে পড়া আলোর পথে সূঁচের মতই দৃষ্টি গলিয়ে দিতে পারলে ঠিকই একবার দেখে নিতে পারতো জুলেখার মুখ। আর সত্যি সত্যিই সে জানালার ফাঁকে চোখ রাখতে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে একবারও ভাবলো না যে খোদার নূরে মুসার পায়ের নিচে তুর পাহাড় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। যদিও মুসা যখন খোদার নূর দর্শনে তুর পাহাড়ে আরোহন করেছিলেন, তখন তাঁর গায়ে ছিলো চামড়ার জোব্বা। পায়ে ছিলো চামড়ার জুতো।  কিন্তু কারি দেলোয়ারের মুনিষ আজমের সঙ্গে ঘর্মসিক্ত  গেঞ্জি-লুঙ্গি আর একটি ভেজা গামছা ছাড়া আর কিছুই নেই। কেবল দৃষ্টিতে ছিলো মুসার মতই নূর দর্শনের ব্যাকুলতা। কিন্তু তার জানা ছিলো না যে, জানালার সঙ্গেই প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করে দাঁড়িয়ে আছে একটি শীর্ণকায় ডালিম গাছ। সে গাছের ডালে যে থাকতে পারে আরো শীর্ণকায় কণ্টক শলাকা তাও ছিলো অজ্ঞাত। ইতোপূর্বে সে এ বাড়ির এতটা ভেতরে কখনো আসতে পারেনি বলে তার দেখা হয়নি ডালিম গাছটিকে। আর অজ্ঞতা তার জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা ঘূণাক্ষরেও যদি সে জানতে পারতো তাহলে সে একবারও মাত্র একটি পদক্ষেপও এগিয়ে যেতো না জানালার দিকে। ফলে সে যখন জানালা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় তার আগেই তার নাকে মুখে এক থাবা বসায় সেই শীর্ণকায় ডালিম গাছের ডাল-পালা। আর তার গায়ে শীর্ণ আঙুলের মত একটি কাঁটা সীমা লঙ্ঘনকারী আজমের ডান চোখে যেন বল্লম হয়ে আঘাত করে। অন্যায়কারীর কণ্ঠে তেমন জোর থাকে না বলেই হয়তো চোখে আঘাত পেলেও আজম কোনো শব্দ করতে সাহস পায় না। নিরব প্রহরীর আচমকা ধাক্কায় যেন সে পেছন দিকে সরে আসতে বাধ্য হয়। গামছা দলা পাকিয়ে তাতে মুখের ভাপ দিয়ে চোখে চেপে ধরলেও তার যন্ত্রণার উপশম হয় না। পরাস্ত সৈনিকের মতই ঢাল-তলোয়ার খুইয়ে যেন নিধিরামের মতই তাকে ফিরে আসতে হয় বাংলা ঘরের সামনে। শেষে চোখে গামছা চেপে ধরে উবু হয়ে পড়ে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের মৌন বিপ্লবী শ্রোতাদের পদদলিত খড়ের উপর।

(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


19 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১

You must be logged in to post a comment Login