শামান সাত্ত্বিক

সময় নিহত অবিরত – প্রথম পর্ব

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

চোখ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার আগেই অন্যদিক থেকে তার শরীরটা এত অবলীলায় চটপটে এগিয়ে আসতে পারে, ধারণা ছিল না একেবারেই সৌরভের। এখানকার এই ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করেছে সরকার, কিন্তু ভূমির অধিকার বা বাসস্থানের চাহিদা তো এই ঢাকা শহরে আকাশচুম্বী। সরকারের অনুগ্রহ লাভের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের যোগান যাদের নেই, তাদেরকে বস্তি নামক মানবেতর বাসস্থানে ঠাঁই নিতে হয়। এক বিশাল আয়তনের মানব বস্তিতে বিবিধ জনপদের মানুষের বিস্তৃতি মানবিক চাহিদা বা আবেদনকে শুধু তীব্রই করেনি, মানুষের ভেতরে নিবৃত্ত ক্ষুধাকে উলঙ্গ করে তোলে। সৌরভ ধারণা করে নেয় রমণী ক্ষুধার্ত। আবাসিক ফ্ল্যাটের পাশের রাস্তা ধরে সে বস্তিগামী হচ্ছিল, ক্ষুধাকে বহন করে, অনিচ্ছায়। ওখানে তার খাবার নেই। হয়তো বস্তি ঘরের শূন্যতায়, ক্ষুধা নিবৃত্তির অভাব তাকে খুন করে বসবে। কিন্তু সৌরভ যে আকর্ষণ এবং কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছিল রমণীটির দিকে, পেটের ক্ষুধার তাড়নায় রমণীটি তার নিগূঢ় অর্থ খুব তাড়াতাড়ি তার মত বুঝে নেয়। তার পেটের ক্ষুধা মেটাতে হলে, পুরুষের শারীরিক ক্ষুধা যে মেটাতে হয়! এই ঢাকা শহরে আসার পর থেকে সে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে।

কিন্তু সৌরভের আকর্ষণটা কেমন ছিল। এমন বয়সের আকর্ষণীয় গড়নের এক যুবতী যদি তার শরীরটাকে আবাসিক ফ্ল্যাটের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে সহজলভ্যতায় তুলে ধরে বা মেলে দিতে চায়, তবে এই দুর্দান্ত দৃশ্যটা কি কিছুটা উপভোগের আবেদন তৈরি করছে না? নারীটির এই তুলে ধরাতে কোথায় যেন আদিম এবং প্রাচীন এক শিল্প লুক্কায়িত হয়ে আছে, তাই খুঁজতে তার দু’চোখ ঔৎসুক হয়ে উঠেছিল। সেই সুযোগে পুরুষকে চেনার অভিজ্ঞতা হতে, রমণী সহজেই সেই পুরুষের শিকারে পরিণত হতে আর মূহুর্তই সময় নষ্টতে প্রস্তুত ছিল না। সে কারণে রমণীর শরীর এগিয়ে আসছিল, সৌরভের উৎসুক দৃষ্টির চেয়ে দ্রুততায়।

রাস্তার পাশ দিয়ে নারীটি শম্ভূক গতিতে হেঁটে গেলে, তাতে দু’টো বিষয় অর্থবোধক হয়ে উঠে। নারীটি পেটের ক্ষুধায় ধীর গতিতে হাঁটছে, সে সাথে তার কমনীয় শরীরটা পুরুষের ক্ষুধাকে জাগিয়ে তুলছে। শাড়ী পরা হ্যাংলা শরীরের এক পাশের কোমর ও পেটের কিয়দংশ অনাবৃত রেখে সে যেমন শিকারীর অপেক্ষায় হাঁটছে, আবার সেই পেটের ভেতরে যে ক্ষুধা তুষের আগুনের মত জ্বলে চলছে, তার তীব্রতা একমাত্র সেই উপলব্ধি করছে। আর শিকারীও ধারণা করে ফেলতে পারছে, একটু দানা-পানি ছিটালেই এই সহজ শিকারটা হাতের কব্জাগত হয়।

দু’দুবার নারীটি সৌরভের দৃষ্টি রেখাকে অনুসরণ করে রাস্তা থেকে উন্মুক্ত আবাসিক ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে আসতে গেলে দু’দুবারই সৌরভ তার দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে নেয়। তৃতীয়বার তার দৃষ্টির প্রক্ষেপন নারীটির উপর স্থির হলে, নারীটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই প্রক্ষেপণের দিকে নির্ভরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। সে নিজে শিকার হলেও শিকারীর প্রতি বিশ্বাস রেখে সে দ্রুত এগিয়ে আসে। বিশ্বাস এক সুনিবিড় আশ্রয়ের, তা যত ক্ষণস্থায়ী হোক। নারীটা শিকারী থেকে একটা দূরত্ব রেখে পেছনে পেছনে এগিয়ে আসে। সৌরভ ফ্ল্যাটের নীচতলায় ভেতরে ঢুকে, সিঁড়ির নীচে অপেক্ষা করে। নারীটি ভেতরে ঢুকলে সৌরভ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। এখন ভরদুপুর। বেলা আড়াইটার উপর বাজে। মানুষজনের আনাগোনা তেমন নেই। বাচ্চারা হয় স্কুল শেষ করে বাসায়, নতুবা এখনো স্কুলে। আর পিতামাতারা অফিসে হলে বেশীরভাগ মায়েরা বাসায়।

সৌরভের আজ অফিসে থাকার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কাল অফিসে এসে দু’সপ্তাহ-র ছুটি নিয়ে নিয়েছে। বলে রেখেছে অফিসে, ভাল না লাগলে আরো এক সপ্তাহ ছুটি নেবে। গতবছরের প্রাপ্য ছুটির অর্ধেক সে কাজে লাগায়নি। লাগানোর তার সুযোগ ছিল না। আর ঘরে বসে ছুটি কাটানো অসম্ভব ছিল। তাই এবারে ছুটি চাওয়ার সাথে সাথে বস্‌ মঞ্জুর করে দিয়েছে। সামান্য প্রশ্নও জিজ্ঞেস করেনি সৌরভকে, ‘কেন হঠাৎ ছুটি চাচ্ছেন?’, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ বসের এই ধরণের নাক গলানো স্বভাব নেই বলে, সৌরভ এতদিন ধরে এই অফিসে কাজ করে যাচ্ছেন। বস্‌ নাক-গলাবেন বা কেন? তিনি কি তাদের অধীনস্থদের মনস্তত্ত্ব বুঝেন না? প্রত্যেকের যে পরিবার আছে। সে পরিবারের যে একটা চাহিদা আছে। সব পরিবারের ভেতর কম-বেশি সংকট আছে, তা তো না বোঝার কথা নয়।

সৌরভ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলে, নারীটি তাকে অনুসরণ করে। সৌরভ যখন সিঁড়ির উঁচু ধাপে উঠে আসে, নারীটি তখন সেই সিঁড়ির নীচু ধাপে পা রাখে। এভাবে সৌরভ তার ফ্লোরে পৌঁছে গেলে দরজার সামনে নারীটির জন্য অপেক্ষা করে। নারীটি শেষ সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে এলে সে ঘরে তার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। একটু পরে খোলা দরজা সরিয়ে নারীটিও ঘরে ঢুকে।

সৌরভ রান্না সেরেছে আজ। গত শুক্রবার বাজারে যায়নি, রান্নাও করেনি। আজ রোববার অফিসে যায়নি বলে বাজারে গিয়েছে। রান্না করেছে। ঝোল করে আলু দিয়ে মুরগী রান্না করেছে। আর করেছে শাক ভাজি ও ডাল রান্না। গত এক বছরে সে ভালই রান্না শিখে গেছে।

তার এক বেডরুমের বাসা। বসার ঘর। কিচেন, ডাইনিং স্পেস পাশাপাশি। নারীটি বসার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলে সৌরভ রান্নাঘরে ঢুকে। সে গড়পড়তা বাঙ্গালী মেয়েদের চাইতে তুলনামূলক লম্বা। হালকা-পাতলা একহারা শরীরের গড়ন। মসৃণ ত্বকে শ্যামলা রঙ মাছের মত ঝিলিক না দিলেও শিং মাছের মত ধীর ধারালো গতি তার। অযত্নে লালিত হলেও নজর কাড়া চুল ও চোখ।

সৌরভ মুরগীর মাংসের বাটি টেবিলে রাখে। মাংসের গন্ধে নারীটির মাঝে একটু কাঁপুনি উঠে। নাসারন্ধ্র আরো প্রশ্বস্ত হয়। সে বসার ঘর থেকে ডাইনিং স্পেসের ঢোকার দরজায় এসে দাঁড়ায়। সৌরভ সাদা ভাতের বোওলটা টেবিলে রেখে তাকে বলে, “যাও, বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসো।”

নারীটি ডাইনিং স্পেসের বাঁ’পাশের বাথরুমে গুটি গুটি পায়ে বাধ্য বালিকার মত ঢুকে পড়ে। ভেজা চোখ-মুখ, ভেজা হাতে নারীটি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে একটু পরে। আর দেরী না করে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। টেবিলের উল্টো দিকে দেয়ালের সাথে লাগানো চেয়ারে বসে। এরই মধ্যে সৌরভ একটা প্লেটে ভাত বেড়ে নারীটির দিকে এগিয়ে দেয়। নারীটি মাংসের বাটির চামচ তুলে নিয়ে বাটি থেকে চটপট দু’টুকরো মাংস এবং এক টুকরো আলু তুলে নেয় তার প্লেটে। সাথে কিছুটা ঝোলও তুলে নেয়। তারপর ভাতের সাথের ঝোল মাখিয়ে খেতে শুরু করে। সৌরভ তার খাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর উল্টোদিকে নারীটির মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়ে। সে প্রথমে শাক নেয়। তার উপর মুরগীর মাংসের ঝোল মেশায়। ঝোলে ভেজা শাক ভাতের সাথে খেতে থাকে। এক ধরণের তৃপ্তি খুঁজে পায়। রেবা, হাঁ, রেবাই তো এভাবে খেতে শিখিয়েছিল তাকে। সে সময় যে স্বাদটা তার ভেতর সঞ্চারিত করেছিল, রেবা-সংশ্লেষে ঠিক সে অনুভূতি, সে স্বাদটুকু এখন খুঁজে পাচ্ছে সৌরভ। নারীটির ডাল নেবার জন্য বাটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে সৌরভ তার প্লেটে ডাল তুলে দেয়। ডাল তুলে দেবার পর প্লেটে আরো কিছুটা ভাত দেয়ার পর, নারীটি হাত তুলে দিয়ে আরো ভাত দিতে বাধা দেয়। সৌরভ বুঝে নেয়, এতটুকুই মেয়েটির খাদ্য। সে মাংসের বাটি থেকে মুরগীর কলিজা এবং এক টুকরা ডানা তুলে দিলে, নারীটির প্রসন্নতা প্রকাশ পায়। এবারে মনে হয়, সে পুরো তৃপ্তি নিয়েই তার উদরপূর্তি করতে পেরেছে। সে নিজে নিজেই উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে আসে। বাথরুম থেকে বের হলে, সৌরভ লক্ষ্য করে এবারেও মেয়েটির চোখ-মুখ ভেজা। সামনের আলনার উপর হাত তুলে গামছা দেখিয়ে সে নারীটিকে বলে, “মুছে নাও।” সে শুধু তার হাতটুকু মুছে গামছাটা আবার স্বস্থানে রেখে দেয়। সৌরভ মনোযোগ দিয়ে নারীটির মুখের দিকে তাকায়। এক মায়াবী আকর্ষণ মেয়েটার ভেতরে লতিয়ে আছে। পুরো শুষ্ক শরীরে একমাত্র চোখ-মুখে ভেজা জলের সিঞ্চন নারীটির ভেতরের সতেজ ভাবটাকে জাগিয়ে রেখেছে। সূর্যতাপে বাসার টবের গাছগুলো শুকিয়ে গেলে, পড়ন্ত বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এলে জল সিঞ্চনের পর যেমন একটা সতেজ ভাব ছড়ায়, নারীটিকেও এখন সৌরভের তাই মনে হচ্ছে। নারীটি ডাইনিং টেবিলের পাশে সৌরভের আড়াআড়ি রাখা বিছানা দিয়ে ঢাকা উঁচু বড় ট্রাংকের উপর শরীর ছেড়ে বসে পড়ে। অপেক্ষা করছে সৌরভের খাওয়া শেষের। ক্লান্ত মনে হচ্ছে নারীটিকে। ঘুম ঘুম ভাব চোখ মুখে। সৌরভ তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে এলে মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। ডাইনিং স্পেস থেকে বেডরুমে ঢুকে পড়ে। ডাবল বেড, দু’টো দু’টো করে চারটি বালিশ। নারীটি ঝটপট শাড়ী খুলতে শুরু করলে, সৌরভ বাধা দেয়, “না, এখন তুমি শোও। ঘুমিয়ে নাও।”

সৌরভ পাশের লিভিং রুম বা বসার ঘরে ফিরে আসে। এইরুমেও দেয়ালের সাথে লাগানো একটা খাটপাতা আছে। পরিপাটি করে বিছানা সাজানো। বিছানার উপর একটা বই খোলা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বইটার কোন মলাট নেই। সম্ভবতঃ পড়তে গিয়ে মলাট নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে খুলে রাখা হয়েছে। সৌরভ বইটা তুলে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর উঠে পাশের বেড়রুমে আসে। নারীটা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। তার বুকের একপাশ থেকে শাড়ী সরে গেছে। কোমল স্তন ব্রা-ব্লাউজের ভেতর জেগে আছে ছোট কমলাকারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের উঠানামায় সেটাও ধীরে উঠছে নামছে। ডানপাশের কোমরও অনাবৃত হয়ে আছে। এক পা একপাশে ছড়ানো। কিছু চুল চোখ ও মুখের উপর এসে মায়াবী এক আকর্ষণ তৈরি করেছে। এরকমের দৃশ্য সৌরভের খুব প্রিয়। সে দেরী না করে লিভিং রুমের শো-কেসের নীচের বড় ড্রয়ার খুলে ক্যামেরাটা বের করে আনে। বেড়রুমের দরজার কাছে এসে থমকে যায়। যে দৃশ্যটা সে একটু আগে দেখে গিয়েছিল, এখন তা পালটে গেছে। নারীটি দু’পা এবং দু’হাত যেভাবে সটান সোজা করে রেখেছে, তা তার চোখের সামনে বীভৎস দৃশ্যটাকে ভাসিয়ে তুলেছে। একটা নিথর, প্রাণহীন নারীদেহ এবং তার পাশে এক/দেড় বছরের এক ছেলে শিশুর চৈতন্যহীন দেহ। মা ও ছেলে একই সাথে সলিল সমাধি পেতেছিল, ডুবুরীরা তুলে নিয়ে আসে জলের গভীর থেকে।

বিভ্রান্ত-উদভ্রান্ত সৌরভ লিভিং রুমে ফিরে এসে ক্যামেরাটা চায়ের টেবিলের উপর রাখে। সে এবার বিছানায় এসে বসে পড়ে। তার মাথা ঝিমঝিম করে। কিছুক্ষণ পর টয়লেট থেকে বেরিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে ফেলে আবার লিভিং রুমে ফিরে আসে। এরই মধ্যে নারীটি ঘুম থেকে উঠে গেছে। কেমন বেকুব অপরাধী ভাব করে লিভিং রুমে সৌরভের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখে এখনো গভীর ঘুমের রেশ লেগে আছে। সৌরভ হাত নেড়ে আলতো করে দু’দু’বার বলে “যাও”। সে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দু’দু’বার সৌরভের দিকে ফিরে তাকিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

পরদিনও সেই দুপুর সময়টাতে সৌরভ ফ্ল্যাট ব্লিডিংয়ের নীচে এসে দাঁড়ায় এবং সে একই সময়টাতে নারীটিকে পাশের রাস্তায় দেখতে পায়। সে যেমন তাকে খুঁজছিল, নারীটিও তাকে দেখার আশা নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। গতদিনের মতই তারা ফ্ল্যাটের ভেতর এসে ঢুকে।

সৌরভ আজ খাসির মাংস রান্না করেছে। সে সাথে বেগুণ ভাজা। ডাল তো আছেই। আজ নারীটি মাংস প্রথমে না নিয়ে বেগুণ ভাজা দিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। তারপর খাসীর মাংস তুলে নেয়। সৌরভ চাচ্ছিল, নারীটি নিজে থেকেই যেন সবকিছু নিয়ে খায়।

আজও খাওয়ার পর সৌরভ তাকে ঘুমাতে বলে। কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে নারীটি। তারপর একসময় বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠার পর সৌরভ তাকে আজও বলে ‘যাও’।

পরদিন দুপুরেও সৌরভ নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে নারীটির দেখা পায়। ফ্ল্যাটের ভেতরে এলে সৌরভ তাকে ঘিয়া রঙের একটি শাড়ী দেয়। তাতে সাথে থাকে একই রঙের ব্লাউজ আর অফ হোয়াইটের পেটিকোট। সৌরভ নারীটিকে গোসল সেরে নিতে বললে, সে গোসলের পর তার দেয়া শাড়ী ব্লাউজ পেটিকোট পরে এবং নিজের পরণের আগের শাড়ী-ব্লাউজ-পেটিকোট ধুয়ে ব্যালকনিতে মেলে দেয়।

আজ খাওয়ার পর সৌরভ নারীটির প্লেটে কিনে আনা সন্দেশ থেকে দু’টুকরো তুলে দেয়। নারীটি খুশি হয়ে তৃপ্তি নিয়ে ভক্ষণ করে। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে নতুন শাড়ী কাপড় পরা নারীটি সৌরভের দিকে মায়াবী চোখ তুলে তাকায়। তারা তখন বেডরুমের ভেতর দাঁড়িয়ে। সৌরভও বিমুগ্ধতা নিয়ে নারীটিকে দেখে। তারপর ঘুরে ঘর থেকে বেরুতে গেলে, নারীটি বলে উঠে কাতরভাবে, “কিছু করবেন না”। সেই একই বিমুগ্ধতা নিয়ে সৌরভ নারীটির দিকে ঘুরে তাকায়, কিন্তু দু’পাশে মাথা নাড়ায়। সে ঘুম শেষে লিভিং রুমে সৌরভের মুখোমুখি হয়ে নীচুস্বরে জানায়, “এইরকম রোজ রোজ কিছু না করলে, আমি আর আসুম না। আমি তো কাম খাইটা পেট চালাই। বিনা কামে না।” সৌরভ শান্তস্বরে উত্তর করে, “তুমি নিজের কাপড় ধুলে, বাথরুমের বালতিতে আমার ভেজা কাপড়গুলো ধুলে না কেন?”
আপনি তো কিছু বলেন নাই।
এখন বললাম।
ঠিক আছে, ধুইয়া দিয়া যাই।

কাপড়গুলো ধুয়ে ব্যালকনিতে আরেক তারের উপর সেগুলি সে শুকাতে দেয়।

এরপর সৌরভের আর নীচে নামতে হয়নি। সে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে মেয়েটা পাশের রাস্তা থেকেই তাকে দেখতে পায়। আর নিত্যকার মত সুর সুর করে চৌম্বক প্রবাহে চলে আসে ফ্ল্যাটে। ঘরে এসেই নারীটা এখন খেতে বসে না। এসেই সে কাপড়-চোপড় পরিস্কার করা থেকে হাঁড়ি-পাতিলও পরিস্কারে লেগে যায়। সৌরভ তার এই কর্মনিষ্ঠাকে উপভোগ করে, পাশের লিভিং রুম থেকে ভেতরে নারীটির কর্মব্যস্ততা মুগ্ধ আচ্ছন্নতায় অবলোকনে নিমজ্জিত থাকে। কাছে এসে ইচ্ছে করে তার দু’বাহু তার দু’হাতে ধরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে হয়ে উঠে না বলে নারীটির কাছে আসে। । তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নারীটি থমকে কৌতূহলী হয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে না পেরে ঘুরে আবার লিভিংরুম মুখী হলে, সে তার হাত ধরে টেনে বলে, “শুনেন, কিছু কইতে চাইছিলেন মনে অয়?” কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে সৌরভ তার টেনে ধরা হাত নিজের দু’হাতের মাঝখানে রেখে কাতরভাবে বলে, “কে গো তুমি? কোথা থেকে এলে?” নারীটি হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে দিয়ে বলে, “এতদিনে জাইনতে চাইলেন? আরো আগে জিগাইলে কইয়া দিতাম।”

সৌরভের নির্বাক দৃষ্টির সামনে সেই বলে, “আমারে বিয়া করিছে এক রসিয়া নাগর। তার ছিল যেমন রুপের বাহার, তেমনি ছিলো রঙের ভাব। আমারে সে বিয়া কইরা ঢাকা শহরে লাল-নীল বাত্তি, দালান-কোঠা-গাড়ী দেখাইতে আনলো। চিড়ায়াখানায় ঘুরাইয়া আনলো। তা সাপ্তা ঘুইরা দশদিনে পড়লে পর, আমার নাগর হইয়া গেলো অন্য এক পুরুষ। ঘুমাইয়া পড়লে মাঝরাতের পর টের পাই, আমার বাসরে অন্য এক পুরুষ। কাম সারার পর টের পাই, সে আমার সোয়ামী না। সোয়ামীর বন্ধু। হে রাইতের পর শুরু হইছে, একেক রাইতে একেক পুরুষ। নাগর আমার এমন রসিক, আমার শরীরের সুখ বিক্রি করলো অন্য মানুষ জনের কাছে। ইটভাটার বেবাগ পুরুষ লইলো আমার থেইক্যা তাগো গ্রামোত রাইখা আসা সুখ। আবার বিয়া না কইরা একলা থাকার হরেক রকম সুখ। আর আমিও হক্কলের কাছে সুখ হারাইতে হারাইতে দিনে দিনে হইলাম ফতুর। নাগরের চিকনাই বাড়লো, হের সাথে রসও বায়া বায়া পড়লো। হে রস আর আমার লাইগা না। হের রসের মাইয়া থাহে ঢাকা শহরে। আমার দিয়া যে ট্যাকা কামাইলো, হে ট্যাকাও মাইয়ার কাছে গেলো। সাভারের কাছেই থাকতাম আমরা। এইসব কত আর সহ্য হয় কও? আমিও একদিন তারে ছাইড়া পলাইয়া এই বস্তিতে উইঠা আইলাম। হে আগে আরো দুইডারে বিয়া কইরা একই কাম করছিলো। হেরাও তারে ছাইড়া পলাইয়া গেছে। এই বস্তিতে এখন থাকতে পারতেছি খালি বশির ভাইয়ের লাইগা। মাসত মাসত তারে ট্যাকা দিলে সব ঠিক। কমছে কম ঈমান আছে তার। নইলে কতজনে আমারে কত ক্ষেতি কইরা বসতো। এখন মাইনষেরে গতরের সুখ দিয়া যে ট্যাকা কামাই, হেইডা তো আর কারো কাছে যায় না। আমার কাছেই থাহে। এইডাই ভালা।”
কই তোমারে তো এখন আর ঐসব কাজে দেখি না। তুমি তো আমার এখানেই এসে পড়েছো। কথাটা সৌরভের মুখ থেকে ফট করে বের হয়ে আসে।
হ, এহানেই তো আইয়া পড়ছি। আপনার যহন ইচ্ছা অইবো কইয়েন, কাপড় খোলার লাইগা আমি রেডি আছি। এই বলে নারীটি তরল হেসে গড়িয়ে পড়ে। এই তরল হাস্যরসের মধ্যে কোথায় যেন একটা শুষ্কতার স্পর্শ লেগে আছে। রোদে ফেটে চৌঁচির কি হচ্ছে এই কলহাস্য?

সময় নিহত অবিরত – শেষ পর্ব

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to সময় নিহত অবিরত – প্রথম পর্ব

You must be logged in to post a comment Login