শামান সাত্ত্বিক

সময় নিহত অবিরত – শেষ পর্ব

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

সময় নিহত অবিরত – প্রথম পর্ব

ভাল লাগছিলো না সৌরভের। দু’সপ্তাহ ছুটি শেষ হয়ে গেলে, অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে, আরো দু’সপ্তাহ আগে সে অফিসে আসতে পারবে না। একটা সুযোগ দিতে চায় বস সৌরভকে, তার পূর্বতন রেকর্ড এবং পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে।

নারীটি সৌরভের বাসায় যথেষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাবলীল হয়ে উঠেছে। নিজের মত করে সে ঘর-দোর গুছিয়ে রাখছে। আগের চেয়ে ঘন্টা দু’য়েক আগে বাসায় এসে রান্না-বান্নায়ও হাত লাগাচ্ছে। এর জন্য কি সৌরভ অপেক্ষা করছিলো? নারীটিকে এই ঘরেরই একটা অংশ মনে হয় তার। শুধু ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্ব রেখে চলেছে তারা যথাসম্ভব।

একদিন সৌরভের বেডরুমের বেডের চাদর পাল্টাতে গিয়ে তার বালিশের নীচে পারিবারিক একটা ছবি দেখতে পেলো নারীটি। সে ছবিতে সৌরভের পাশে এক নারী, আর তাদের মাঝামাঝি ছোট একটা ছেলে বছর এক/দেড়েক বয়স হবে। একটু আঁতকে উঠে নারীটি। তাইতো, একবারও এই মিনসেটাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, তার পরিবার আছে কি নাই? নিজের ভাব-সাবে নারীটি একটু দমে গেলো। গতরের সুখ দিতে দিতে পুরুষগুলারে, তাগো ঘরের খবর আর জিগান হয় না কুনদিন। তাগো বউ আছে কি নাই, সেইটা আর তার মাথা ব্যথা থাকে না। কাম করতে আইছে কাস্টমার, কাম সাইরা ট্যাকা ফালাইয়া চইলা যাইবো। বাস্‌। কিন্তু এই মূহুর্তে সৌরভের পরিবার সম্পর্কে আগে তারে জিজ্ঞেস করেনি বলে, নিজে নিজেই শরমিন্দা হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে ফালতু, ছোট মনে হলো। সেদিন বাজার করে ফিরে আসার পর দরজা খুলে সৌরভ বাসায় ঢোকার পর পরই নারীটি হামলিয়ে পড়ে তার উপর। “আফনের যে বউ আছে, হেই কতা আমারে আগে কইলেন না কেন্‌? আমি কি তার কোন ক্ষতি করছি এতদিন? তাড়াতাড়ি কইয়া ফালান। এতো ভালা মানুষ হইয়া থাকনের দরকার কি? তওবা তওবা, সব পুরুষ মাইনষের চরিত্র যে একই হেইডা আমি ভুইলা গেছিলাম আপনারে দেইখা। হায় আল্লা, আমি কী ভুল করলাম!” নারীটি হতাশ অস্থির হয়ে চীৎকার করে উঠে এক প্রকার।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌরভ বলে, “তুমি এরকম ক্ষেপেছো কেন? পারো যদি একটা উপকারই করো না আমার। যাদের ছবি তুমি দেখেছো, ওদেরকে একবার কবর তলার ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসো। বলো আমাকে তারা বরিশাল থেকে ফেরার পথে জলজাহাজ থেকে জলের অতলে নেমে জলরাজ্যে প্রাণখুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লঞ্চ ডুবি হয়নি, তাদের ওখানে সলিল সমাধিও হয়নি।” আবেগে এক প্রকার কেঁদে ফেলে সৌরভ। বসার ঘরের সোফার পাশেই বাজারের ব্যাগ রেখে সে সোফার হাতলের উপর উপুড় করে মাথা দিয়ে কাঁদতে থাকে নির্বোধের মত অঝোরে।

নারীটিকে সৌরভের কান্না স্পর্শ করেছে কী না, বোঝা যায় না। কখন সে কোন এক পুরুষকে এভাবে কাঁদতে দেখেছে, ঠিক স্মরণ করতে পারে না। একটু পরে একটু নীচু স্বরেই “ভালা মাইনষের কপালে আল্লা এমনই রাখে” বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আমারও তো পোড়া কপাল, নাইলে কি আর আমনের কাছে আইসা ভিড়ি?” মেয়েটা নিজেকে, না কি সৌরভকে সান্ত্বনার বাণী শোনায়। ঠিক ঠাহর করা যায় না।

সময় দ্রুতই এগিয়ে যায়। সৌরভের অফিস ছুটি শেষ হতে আর দিন দশেক বাকি। আজকাল খুব ছবি তুলে যাচ্ছে সে, কেমন এক মোহগ্রস্থ হয়ে। রেবা ও দীপ্তকে নিয়ে এমন করে ছবি তোলেনি। যখন ইচ্ছে হয়েছে, ভাল লেগেছে যখন, তুলেছে। এখন এমনভাবে ছবি তুলছে যেন অনেকদিনের অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতিকে বা সূক্ষ্ম সময় বা মূহুর্তকে তোলার বাকি রয়েছে, তোলা হয়নি আগে, এখন তুলে নিতে হবে। ছবি তোলার উন্মাদনা, এক উন্মাদ আকর্ষণকে সে ছেড়ে দিতে চায় না। এখন এই মূহুর্তগুলোকে বন্দী করতে না পারলে তা চিরদিনের মত আড়ালে থেকে যাবে যে! তাই সে ক্লিক করে। তার ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করে। রাবেয়ার দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজের প্রতিটি বিবিধ মূহুর্তকে সে ক্যামেরা বন্দী করছে। ভাল লাগাটা তার আরো বেড়ে চলেছে, এইভাবে যত বন্দী করছে ক্যামেরায়, তত। রাবেয়া অবাক হয়। ‘এই মিনসে-টার মাতায় ছিট আছে’ এমনই ভাবে সে। কখনো কাজ করতে গেলে শরীর থেকে শাড়ি সরে গেলে, তখনই এই মিনসেটাকে ছবি তুলতে দেখলে, কুপিত রাগ হয়। দ্রুত শাড়িটা শরীরে তুলে নিতে চেষ্টা করে সে। মিনসেটার এরকম ছবি তুলতে দেখে আজকাল তারও ইচ্ছে করে, একটু আধটু সাজি। সাহেবগো ঘরের বৌগের মত। পুরুষগোরে তার গতরের সুখ দিতে তকি একরকম সাজুনি আছিল। সে সাজুনি তো এই মিনসের পছন্দ অইবো না, রাবেয়া অনুধাবন করে। তা অইলে কি আর পরথম যেদিন তার শুকনা মুখ-চুল-শরীর নিয়া যখন রাস্তা দিয়া হাইটা গেছিল, তখন মিনসেটা কি তার দিকে এমন নজর দিতো? কী নজর যে ছিল, রাবেয়া এখনো ঠিক বুঝে উঠে না। নজরটার মধ্যে কিছু একটা আছিল। নাইলে মিনসেটা তার দিকে তাকাইয়া থাকার পর সে এমন কইরা তার দিকে চইলা আসবে কেনো? অইন্য পুরুষ অইলে, সাত-পাঁচ ভাবতো রাবেয়া। ট্যাকা-পয়সা, কাম-কাইজের সুবিধা-অসুবিধা, ভালা-মন্দ বিচার করতো। এমন কত হারামির বাচ্চা আছে, তার শরীররে যেমুন-তেমুন কইরা লুইটা নিতে চাইছে, কেউ কেউ কী কষ্টটাই না দিছে! এই মিনসেরে দেইখা এমন কিছুই তার চিন্তা অয় নাই। নিজেই অবাক হয় রাবেয়া, কেমন সুরসুর কইরা এই মিনসের পিছন পিছন ঘরে আইসা ঢুকছে। ঘরটারে তো নিজের ঘর যেমন মনে অয় নাই, তেমন অন্যের ঘরও মনে অয় নাই। মনে অইছে পইড়া থাকা একটা আম-কাঁঠোলের বাগান। যে বাগানে বেবাক ভালা মাইনষে বইসা জিরাইয়া নিতে পারে। আবার ঘুমাইতে চাইলে পরাণ ভইরা ঘুমাইতে পারে একদন্ড। আহ্‌ হায়রে, এই লোকের জন্য সে কি কিছু করতে পারবো? প্রমাদ গোনে রাবেয়া।

মিনসেটা তার কত ছবিই তুলছে! একসময় অনেক শখ ছিল ছবি তোলার রাবেয়ার। সেই তো ইদ্রিসের ভাই ইলিয়াস গ্রামে নতুন ক্যামেরা কিনা আইনা, তাগো কত বাড়ির কত মাইনষের যে ছবি তুলছে! একদিন হে রাবেয়ার ছবি তুইলা ক্যামেরার মইধ্যে দেখাইলে, রাবেয়া কী খুশি অইছিল! ইচ্ছা করছিলো, আরো অনেক রকম শাড়ি, আর কামিজ পইড়া আরো অনেক কিসিমের ছবি তোলার। গাঁওয়ের ইদ্রিস ভাইয়ের বউ, আয়েশা ভাবীর সালোয়ার-কামিজ, আর শাড়ি ব্লাউজের ছবিগুলা কী সোন্দর লাগছে!বেডি আবার বেডাগো মত ইলিয়াস ভাইয়ের শার্ট-প্যান্ট পইড়া ছবি তুলছে সিনামার নায়িকাগো মত। রাবেয়ারও তখন মনে অইছিল, সে যদি সিনেমার নায়িকা অইতো, কত কিসিমের কাপড়-চোপড় পইড়া ছবি তোলবার পারতো। এখন মনে করে, সবই তো কপাল। কপাল না অইলে কিছুই করা যায় না। বুক থেকে দ্রুত শ্বাস বের হয়ে আসে রাবেয়ার।

এত ছবি তুলেও স্বস্থি পায় না সৌরভ। কী যেন একটা মিস করছে, মিস করছে – এমন ভাব। একবার মনে হয়, নারীটাকে ঝাপটে ধরে বুকে চেপে রাখি। তার ভেতরটা উন্মোচিত করি। নারীটি মিশুক, সৌরভের বিশুদ্ধ আদরের সাথে। সৌরভে বিলীন হোক তার অস্তিত্ব, অথবা নারীটাকে আরো বেশি অস্তিত্বময় করে তুলুক সৌরভ তার আদর সোহাগে, কামনার রাগে। তারপর সে চোখ তুলে তাকাতে চায় আলিঙ্গনাবদ্ধ নারীটির চোখে।

হুম, এইতো, এইভাবেই তো রেবা বসে, তরি-তরকারী বটিতে কাটে। ক্যামেরায় সঠিক এ্যাঙ্গেলটা দেখে। লেন্সটাও সে সাথে দূর-কাছে করে। হাঁ, এইতো, এইভাবে এলেই রেবার ছবিটা ভাল আসে। ক্যামেরায় ক্লিকের আওয়াজ উঠে। সব্জি কাটা হলে, হাঁড়ি একটা ধোয়, চুলা জ্বালায়। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে তেল ঢালে রাবেয়া। তেল গরম হতে হতে একনজর সৌরভের দিকে তাকায়। সৌরভের চোখ ক্যামেরা ভিউ ফাইন্ডারে। রাবেয়া হাসে, ঠিক রেবা যেভাবে তাকিয়ে তার দিকে হাসতো। ক্যামেরায় ক্লিকের আওয়াজ উঠে।

দুপুরে গোসল সেরে রেবা তোয়ালে দিয়ে তার ভেজা চুল ঝেড়ে নিতো। বারান্দায় টবের গোলাপ গাছের পটভূমিতে দৃশ্যটি ভালই মানিয়ে যেতো। তন্ময় হয়ে তা দেখতো সৌরভ আর ক্যামেরাতে ধরে রাখতেও দ্বিধা করতো না। দ্বিধা যা ছিল, রেবারই। বলতো, ‘আমার এসব ছবি তুলছো তুলছো, কিন্তু আর কাউকেই দেখাতে পারবে না। তোমার কাছেই থাক এই তোমার ভাল লাগা। যদি কোথাও কাউকে দেখাও, তবে খবর আছে।’ হাঁ, সৌরভও তার কথায় শ্রদ্ধা দেখিয়ে আর কাউকে ছবিগুলো দেখতে দেয় নি। রেবা-দীপ্ত গত হলে সেই ছবিগুলো আরো গভীর গোপনে সেঁধিয়ে গেছে। তার খোঁজ শুধু সৌরভেরই আছে। কেউ সহজ কষ্ট করেও সে ছবিগুলো খুঁজে বের করতে পারবে না।

আজ হঠাৎ করে গোসলের পর রাবেয়া-কে ব্যালকনিতে এসে তার চুল তোয়ালে দিয়ে ঝাড়তে দেখে সে চমকে উঠে। ভেতরটা নেতিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করেও প্রকাশ করতে পারে না। এমন বিভ্রান্ত ভাব তার কদাচ জন্মায়। মোহাবিষ্টতা, সন্মোহন এবং স্বপ্ন-বাস্তব সব একাকার হয়ে যায়। এ কে? না, রেবা, রেবার প্রতিমূর্তি। রেবাকে সে এবার যেতে দেবে না। যে করেই হোক, তার পুরোটাকেই সে ধরে রাখবে। সময়, প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা অঙ্গ-ভঙ্গি সে তার নিজের করে নেবে, একান্তই নিজের। যাতে আর কখনো তাকে হারানোর যন্ত্রণায় পুড়তে না হয়। পোড়া সুখ, বা পোড়া আত্মা কেউ কি কখনো দেখেছে? যদি দেখতো, তবে এতদিনে শুধু সৌরভকেই সে দেখতো। এক ঘোরের মধ্যে থেকেই সে ক্যামেরাটা ড্রয়ার থেকে দ্রুত বের করে এনে রাবেয়ার চুল ঝাড়ার দৃশ্যের ছবি তুলতে শুরু করে। ক্যামেরায় ক্লিকের আওয়াজ উঠে।

রাবেয়া মাথা ঘুরিয়ে অন্যপাশের চুল ঝাড়তে গিয়ে সৌরভকে দেখে কিঞ্চিৎ মিষ্টি হাসে। অনেক পুরুষকে দেখেছে সে। তারা শুধু তাদের বিকৃত পৌরুষই দেখাতে চেয়েছে, নারীর উপর জোর খাটিয়ে। কিন্তু এই লোকটার এমন বাচ্চা ছেলেসুলভ মানসিকতা রাবেয়ার পোড়া ক্ষতে প্রশান্তির আবেশ মাখে। আজকাল আর কিছু বলে না, সে শুধু লোকটার বাচ্চামানুষি তারিয়ে তারিয়ে দেখে। কখনো কখনো মনের গোপনে উৎফুল্লতার ঢেউ খেলে। জীবন এমন হয় না কেনে? জীবন এমন কঠিন কষ্ট কেনে? মানুষগুলা জীবনডারে এতো কঠিন পাত্থর করে কেনে? জীবন সুজা-সিদা চলে না কেনে? রাবেয়ার ভেতরেও বিলাপ বাড়ে উনুনে উনুনে, বাষ্পে বাষ্পে, কলের তলের জলের চীৎকারে। নিজের পতিত জীবনে পতিত শরীরটা একটা ঘৃণার বাহন হয়ে উঠে। ক্ষতে তুষের আগুনের মতো যে জ্বালা-যন্ত্রণা বইতে থাকে সৌরভের বাচ্চামানুষি শুধু তা থেকে রাবেয়ার মনকে অন্য ধারায় আনন্দ জোয়ারে প্রবাহিত করে।

সন্ধ্যার আগে আগে রাবেয়া বস্তিতে ফিরতে গেলে সৌরভ পথ আগলায়। বাচ্চা ছেলের মাঝে রোমান্টিকতা ভর করে, “তুমি আজ বাড়ি যাবে না। এখানে থাকবে।” রাবেয়া অনেকটা চীৎকার করে উঠে, “কি কন আপনে?” একটু রয়ে আবার বলে, “আমি কি আপনের বিয়া করা বৌ? মাইনষে তো আপনেরে খারাপ কইবো!” তারপর একটু নীচু স্বরে বলে, “এহনো যদি জানে আমি আসলে কে, তাইলে আপনেরে কী আর ভালা জানে!”

সৌরভ পথ আগলিয়ে রাখে। সরে যাওয়ার কোন লক্ষণই নেই। যেন জিদ ধরেছে বাচ্চাটা। বাচ্চার সন্তুষ্টি না করে কি উপায় আছে? তা না করে, রাবেয়া একটু ঝামটা দিয়ে বলে, “না, সরেন! অনেক অইছে, এর বেশি অইলে কপালে খারাপি আছে। এত সোহাগ ভালা না।” সে মূর্তির মত মিইয়ে পড়া সৌরভের পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

পরদিন ঠিকই রাবেয়া আসে। অন্য দিনকার মত ঘরের কাজগুলো সারে। গোসল খাওয়া ছেড়ে কখন যে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেয়। বেশ গরম পড়েছে। রাতে ঘুমানো কষ্টকর এই গরমে। বৃষ্টির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সিলিং ফ্যানের বাতাসে গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ে। সৌরভ একবার শোয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। রেবার এমন ঘোর ঘুমের মাঝে দীপ্ত একপাশে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমানো দীপ্তকে আদর করতে দারুণ ইচ্ছে করে। তার ফোলা গালে চুমু দিতে চায়। বিছানার ধারে রেবাকে ডিঙ্গিয়ে কতবারই না সে দীপ্তর গালে চুমু দিয়েছে। রাবেয়া নড়ে উঠে এ সময়। তার চুলগুলো শুকিয়ে এলোমেলো আজ। অদ্ভূত লাগছে এই নতুন শাড়িতে। রেবারই শাড়ি, খুব প্রিয় একটা শাড়ি। সৌরভ কিনে দিয়েছিল পছন্দ করে। কমলা-শাদায় মাখামাখি শাড়িটি। রাবেয়া তো নয়, রেবা যেন এলোচুলে কাতর ঘুমে। দীপ্তর কারণে রাতে ঘুমুতে না পেরে এখন বেঘোর ঘুমুচ্ছে। স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে যে তাকে। রেবার গালেও কি আলতো চুমু দেবে সে? বরং ক্যামেরাটাই নিয়ে আসা হোক। এমন দুর্লভ দৃশ্য, সচরাচর মেলে না। ঘুমে বেহুশ মার পাশে সন্তানও গভীর নিদ্রাশ্রয়ী। মনে হয়, শিশু তার কল্পলোকে হেসে খেলে বিচরণ করছে। ঘুমে সে হাসছে। ফেরেশতাদের সাথে কি হাসি বিনিময়? হা কী নিশ্চিন্ত, নিরাপদ। এই দৃশ্যকে ক্যামেরা বন্দী না করে সৌরভ পারেই না। ক্যামেরায় ক্লিকের আওয়াজ উঠে।

অনেকক্ষণ পর রাবেয়া ঘুম থেকে উঠে। বেলা তখন অস্ত যেতে প্রস্তুত হচ্ছে কেবল। ঘুমের নেশায় এখনো সে ডুবে আছে। যেভাবে সে বিছানার উপর বসে আছে, তাতে মনে হচ্ছে, দীপ্তকে সে এখনই স্তন্য পান করাবে। কোলে তুলে নেবে দীপ্তকে এখনি। মাতৃত্ব দিয়ে জড়াবে কিছুক্ষণ। উপলব্ধি করবে তার ভেতরের মাতৃরুপের বয়ে যাওয়া ফল্গু ধারা। হাঁ, তেমনি তার চুল দু’পাশে ছাড়িয়ে রেখেছে রেবা। দীপ্ত কোলে উঠেই যে কাজটা প্রথম করবে, তা হলো, তার তর্জনীকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মায়ের চুলকে আঙ্গুলে পেঁচাবে। তারপর মায়ের স্তন্যের বোঁটাটা মুখে পুরবে। ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে খোলা দরজা দিয়ে সে দৃশ্য দেখার জন্য সৌরভ উদগ্রীব হয়ে আছে। ক্যামেরাটা সে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে।

টেবিল থেকে ক্যামেরা নিয়ে এসে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে সৌরভ। বেড়রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। এখন আরো ভালভাবে বোঝা যাচ্ছে, ঘুমের রাজ্যে পরিভ্রমণ শেষ হয়নি রাবেয়ার। আরো কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলেই হতো। ঘুম রাজ্যের দ্বারের ভেতরে থেকে সেও চোখ তুলে তাকায় সৌরভের দিকে। দু’পাশের ছড়ানো ফোলা চুল আরো বেশি তন্দ্রাচ্ছন্নতা ছড়িয়ে দিয়েছে। তার রমণীয় মাতৃত্বরুপ আরো বেশি যেন আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। সৌরভের মাঝে উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়েছে। আহ্‌ কতদিন রেবার এই রুপটি তার দেখা হয় না। দীপ্ত কই। কেন তাকে সে কোলে তুলে নিচ্ছে না। কখন যে সে ভাব বিহবল মধুরতা রেবার সারা মুখে চোখে শরীরে ছড়িয়ে যাবে! মাতৃত্বের চরম পরাকাষ্ঠা। ওইতো রেবা দীপ্তকে কোলে তুলে নিয়েছে। সে আসন পেতে বসেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনই সে দীপ্তকে তার কোলে শুইয়ে স্তন্য মুখে পুরে দেবে। আরে, রেবা তার স্তনের কাপড় সরিয়ে দীপ্তের মুখে দিচ্ছে না কেন? স্বগত স্বরে সৌরভ বলে উঠে, “রেবা, রেবা।” সে ঘুমের জগতের দ্বারে এসে রাবেয়া আবার সৌরভের দিকে তাকায়। তার ঘুম কিছুটা বিতাড়িত হয়েছে। সে ঘুম রাজ্যের দ্বার থেকে বেরিয়ে আসছে। “রেবা, রেবা, তুমি দীপ্তকে স্তন পান করাচ্ছো না কেন? কি হলো?” একটু অবাক ভাবে সৌরভের দিকে তাকায় এবার রাবেয়া। সৌরভ তখন তার ক্যামেরাতে লুক থ্রু করছে। সে দেখে নিচ্ছে, কেমন হবে তার ক্যামেরার ফ্রেম। মা ও শিশুকে একই ফ্রেমে কিভাবে বাঁধা যেতে পারে। সে তার ক্যামেরা স্পিড, রেজুলেশান ঠিক করে। এই আলোতে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা ঠিক হবে না। শিশুর সমস্যা হবে। যতদূর পারা যায় ব্যালকনির দরজা এবং জানালা দিয়ে আসা আলোটাকে সে ব্যবহার করে ছবি তুলবে। কি হলো, এখনো রেবা তার স্তন বের করে দীপ্ত-র মুখে দিচ্ছে না কেন? ক্যামেরায় লুক থ্রু অবস্থায়, সৌরভ এবার একটু জোর দিয়েই বলে ফেলে, “রেবা, বুক থেকে কাপড় তোল তো! তোল না! হ্যাঁ, একটু, এই তো তোলো না!” সৌরভের অধৈর্যতায় রাবেয়া মোলায়েম অথচ তীক্ষ্ণ গলায় বলে, “না, আমি রেবা না, আমি রাবেয়া।” হ্যাঁ, ধ্যান ভাঙ্গছে কে সৌরভের? সে গলায় স্বর আরেকটু জাগিয়ে উঁচু করে বলে, “কাপড় সরাও বুকের বলছি।”
“না, আমি কাপড় সরাবো না।”
“হ্যাঁ, কি বলছো তুমি? কাপড় সরাতে বলিনি।” উন্মত্ততার কাছে বাস্তবতা উড়ে গেছে তখন। চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে নেয় সৌরভ। কেমন যেন ফ্রেনেটিক হয়ে উঠে, “একটা রাস্তার মেয়ের আবার এমন দেমাক কেন? কথা বললে, কথা শোনে না।”

এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না রাবেয়া। সেও তার তেজকে মোলায়েম করে দ্রুত বলে, “তখন আছিলাম, এখন না।”

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাবেয়ার দিকে সৌরভ। “মাগী মাগীই! তখনও ছিলে,এখনো তাই!” – বলার পর পরই সম্বিত ফিরে আসে সৌরভের। এ কী কথা বললো, বিশ্বাস করতে পারে না সে। কি বলে ফেললো সে? কেমন করে বললো সে? কি করে এখন সে? নিজেই স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর পর ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেই ঔষধ সেবনের বদৌলতে, এর পরের তিনদিন ঘুমের মধ্যে সৌরভ ডুবে থাকে। এরও দু’দিন পর সে অফিস যাওয়া শুরু করে। ঘুমের মাঝের সেই তিনদিন ঘরের বাইরে দরজার সামনে, পায়ের খসখস আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু দরজায় কোন টোকা পড়েনি।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login