ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৬
মমিন উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলের বারান্দায় বসে কাঁধের গামছা দিয়ে ডান চোখের পানি মুছছিলো আজম। ব্যথা আপাতত না থাকলেও চোখটা কেমন ফুলে আছে বলে মনে হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আয়নায় চোখের পাতা দুটো টেনে দেখেছে যে, ভেতরটা যেন শুকনো পাকা মরিচের মতই লাল হয়ে আছে। চেষ্টা করলে চোখটা সামান্য মেলতে পারে। কিন্তু তারপরই সেটা আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।
হরি ঘোষ গরু ও মানুষের চিকিৎসা করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। চোখে আঘাত পাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই আজম হরি ঘোষকে চেপে ধরেছিলো। বলেছিলো, দাদা, আমার চোখটার কি হইলো?
তখন চোখ দেখে হরিঘোষ বলেছিলো, কিছুর গুতা লাগছে লাগে!
তখনই ব্যস্ত কণ্ঠে আজম বলে উঠেছিলো, হেদিন পশশু রাইতে নৌকা বাইয়া আইতাছিলাম সুরানন্দী থাইক্যা, তহনই মনে হইলো চোখে কিছু একটা আইয়া উইড়া পড়লো।
আজমের কাতর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হরি ঘাষ বলে উঠেছিলো, হাতির শূরের পাতার রস লাগাও!
এইডা তো চোখ উঠলে দেয়!
এ ছাড়া অন্য কোনো গাছন্ত অষুধের কথা আমার জানা নাই।
হরি ঘোষ বুঝতে পেরেছিলো, অসাবধানে সরু আর শক্ত কিছুর খোঁচা লেগেছে চোখে। কিন্তু কথাটা কোনো কারণে হয়তো গোপন করছে আজম। আর গোপন করলে করুক। সত্যি কথা বললেও এই বদের বাচ্চার চিকিৎসা করতো না সে। তা ছাড়া কারি দেলোয়ারের মতই সাড়ে হারামজাদা এই মুনিষ আজমও। তার আজে বাজে কথার কারণেই মমতার স্কুলে আসা বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। নয়তো ছাত্রী হিসেবে মেয়েটা মন্দ ছিলো না। এ নিয়ে কারি দেলোয়ারের কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি। উল্টো তাকে শুনতে হয়েছিলো, মালাউনের মাইয়ারা বেশরমের মত রাস্তাঘাটে চইল্যা আমাগো মোসলমানের পোলাগুলারে খারাপ করছে। মাইয়া মানুষ ইস্কুলে পাঠাস কেন?
হরি ঘোষ আজমের বুঁজে থাকা ফোলা চোখটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলো যে, দিনদিন চোখটা আরো খারাপের দিকেই যাবে। যেহেতু এখনই সে চোখটা দিয়ে দেখতে পায় না কিছু, তার অর্থ ভবিষ্যতের জন্য চোখটা পুরোপুরিই অকেজো। কিন্তু কথাটা সে মুখ ফুটে কাউকে বলেনি এ পর্যন্ত।
দূর থেকে আজমকে স্কুলের বারান্দায় দেখতে পেয়েই ভাবতে ভাবতে আসছিলো হরি ঘোষ। আর তাকে দেখতে পেয়েই বসা থেকে উঠে ছুটে আসে আজম। গলায় পেঁচিয়ে রাখা হরি ঘোষের গামছা টেনে ধরে আজম কঠিন গলায় বললো, মালাউনের বাচ্চা মালাউন, হামিদের চোখ ভালা করতে পারলি চউখের মলম দিয়া আর আমারে ব্যবস্থা দিলি চউখ উডার পাতা দিয়া?
হরি ঘোষ আজমের ভাবগতিক দেখে ভয় পেলেও তা প্রকাশ করে না। খানিকটা নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করে বললো, হামিদের চোখে কঞ্চির খোচা লাগছে। আর তোমার চোখে কইছ কিছু একটা উইড়া আইয়া পড়ছে। দুইডার চিকিচ্ছা কি এক হইবো? তোমার বুঝে কি কয়? আগুইন্যা পোকের ঘষা আর গান্ধীর পাদের চিকিচ্ছা কেমন এক হয়?
আজম হরি ঘোষের গামছা ছেড়ে দিয়ে কেমন হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হরি ঘোষ তাকে পাশ কাটিয়ে বিবির ছইয়া গ্রামের দিকে যেতে থাকলেও কিছু বলে না। মনেমনে ভাবে যে, তাহলে সত্যি কথাটা বললে কি সত্যি সত্যিই তার চোখের উপযুক্ত চিকিৎসা মিলতো?
হরির পেছন থেকে অকস্মাৎ সে চেঁচিয়ে উঠে বলে, বন্দুকটা হাতে পাইয়া লই, সবতে আগে তরে গুল্লি দিমু!
আজমের কথা শুনে সত্যি সত্যি ঘরি ঘোষের মনে ভয় হয়। কারণ চারদিকে যা দেখা যাচ্ছে এদেশে বাস কারা আর হয়তো সম্ভব হবে না। আর এ কথা মনে হতেই হরি ঘোষের হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে আসে। হাঁটুর শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে আসে। তাই খানিকটা এগিয়ে হজিমুল্লার কাঁঠাল গাছের নিচে মাটির ওপর ধেবড়ে বসে পড়ে।
পান্তার বাজারে পাকি সৈন্যরা ঘাঁটি বানিয়েছে। আশপাশের গ্রামগুলোতে এ নিয়ে দিনরাত আতঙ্কে আছে মানুষ। বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি তাদের আক্রোশ বেশি দেখা যায়। যে কারণে অনেক হিন্দুই ঘরবাড়ি ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর তাদের পরিত্যক্ত গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি দিয়ে প্রতিদিন মচ্ছব করছে। প্রথমেই তারা নারায়ণের রেডিও সারাইর ঘরটা পুড়িয়ে দিয়েছে। পুড়িয়েছে বিশু আড়ৎদারের ঘরও। গুড়ের হাঁড়ি-মটকা সব লুট হয়ে গেছে।
লোকমুখে শোনা গেছে যে, পাক বাহিনীর লোকেরা পান্তার বাজারে উঠেই প্রথম বিশুর বুকে বন্দুক ধরে বলেছিলো, থোম মুসলিম ইয়া হিন্দু? খলেমা বাথাও!
বিশু গড়গড় করে কলেমা আউড়ালেও তার পরনের ধূতি দেখে অন্য একজন বলে উঠেছিলো, হিন্দুকা ধোতি কিউ প্যাহনা?
বিশু ধূতির কোচা দিয়ে গুড়ের মটকা মুছে দেখিয়ে বলেছিলো, ঝাড়-পোছের কাজে লাগে।
পাক বাহিনীর লোকেরা বিশুর আড়ত থেকে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে বেরিয়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বিশু। বুক অবধি পানি ভেঙে বাড়ি চলে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই নাকি আকবর মোল্লা পাকিদের জানিয়েছিলো, সাহাব, ও আদমি সাচ্চা হিন্দু হায়। খৎনা নাহি হুয়া!
আকবর মোল্লার কথা শোনার পরই হয়তো বিশুর আড়তে আগুন দিতে বলেছিলো ওরা। কাজটি মহা উৎসাহে নিজেই নাকি দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছে সে।
সে রাতেই বিশু গ্রাম ছেড়েছিলো। পরিবার পরিজন নিয়ে চলে গেছে দূরে। এখন নাকি সে ভারতে আছে। হিন্দুরা দলে দলে দেশ ছাড়ছে। হরি ঘোষের তো কেউ নেই ভারতে। সে কোথায় যাবে? কার কাছে গিয়ে উঠবে?
সিদ্ধেশ্বরী থেকে মতিউর রহমানের ভাই নাজিউর রহমান আর সুরানন্দী থেকে হোসেন মৃধার ছেলে হাসন আলি। বিবির ছইয়া থেকে আলিম সহ আরো কয়েকজন। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে গেছে। তারও হয়তো যুদ্ধে যাওয়াটাই সব দিক থেকে নিরাপদ ছিলো। কিন্তু মমতাকে একাএকা বাড়িতে রেখে কোথাও গিয়ে স্বস্তি পায় না সে। কিন্তু নিজের গ্রামও এখন আর নিরাপদ নয়। শোনা যাচ্ছে স্কুল ঘরে পাকিসৈন্যদের ঘাঁটি বসবে। তখন তো আরো বিপদ হবে।
দিনরাত ভেবে কোনো থই পায় না হরি ঘোষ।
মমতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হরি ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা, চল্আমরাও যুদ্ধে যাই! পান্তা বাজারের কাছাকাছি কোনো গ্যারামের বউ-মাইয়া ঘরে নাই। যারা ঘর-বাড়ি ছাইড়া যাইতে পারে নাই, আকবর মোল্লার দল হ্যাগোরে ধইরা নিয়া বাজারের পাকিগো হাতে তুইল্যা দিছে!
মেয়ের কথা শুনে হরি ঘোষের বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে যেন। সে বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে মমতার দিকে তাকিয়ে বলে, তুই এই খবর পাইলি কই?
জুলেখা কইছে। তার দাদায় নাকি কাইল আইছিলো।
হরি ঘোষের ইচ্ছে হয় এখনই মেয়ের হাত ধরে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু কোনো দিশা না পেয়ে শেষ ভরসা হিসেবে সে আসে হোসেন মৃধার কাছে। হোসেন মৃধা তার সংকটের কথা শুনে বললো, তোমার মাইয়ারে আমার বাইত্যে দিয়া যাও। জুলেখা বাঁচলে মমতাও বাঁচবো!
আবাল্য হোসেন মৃধার সঙ্গে সখ্য থাকলেও তার কথায় তেমন ভরসা পায় না হরি ঘোষ। শত হলেও হোসেন মৃধা মুসলমান। দেশের এমন নাজুক অবস্থায় একজন হিন্দুর দৃষ্টিতে আরেকজন মুসলমান হয়তো ততটা নিরাপদ আর নির্ভরযোগ্য নয়। তবুও চারদিকের বিপদ, অবিশ্বাস আর নিরাপত্তাহীনতার ভেতর যেন হোসেন মৃধা মন্দের ভালো। তাই শেষটায় চোখের পানিতে নিজের গাল বুক আর মমতার মাথা ভিজিয়ে হরি ঘোষ মমতাকে নিয়ে আসে হোসেন মৃধার বাড়িতে।
(চলবে)
6 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৬
You must be logged in to post a comment Login