জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১২

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

প্যান্ট সার্ট পরে গাঢ় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতেই তিনজনকে কেমন অচেনা মনে হয়। চেহারা বুঝতে না পারার কারণে হাসন আলি চান্দভানু , মমতা, আর জুলেখাকে আলাদা করতে পারে না।

হোসেন মৃধা প্যান্ট-সার্ট পরে না। প্যান্ট-সার্টগুলো এখন মেয়েদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বেশি।

সারাদিনের মৃত্যুভয় আর নিজকে রক্ষার উত্তেজনার কারণে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলেছিলো চারজনেই। এখন নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলতে পারছে বলে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন আর চাহিদাগুলোও একে একে প্রকট হয়ে উঠছিলো। এগুলোর মাঝে ক্ষুধার প্রাবল্যে হোসেন মৃধার শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছে। সঙ্গে চিড়া-গুড় নেই বলে মনেমনে খুবই আক্ষেপ হতে লাগলো। গুলির শব্দ শুনে আর আগুন দেখে পালানোর সময় চিড়া-গুড়ের পুটলি কোথায় পড়ে গেছে ওদের কেউ বলতে পারবে না। হয়তো ওগুলোর কথা কারোরই মনে নেই।

ব্যাপারটি বুঝতে পেরেই যেন হাসন আলি হঠাৎ বলে উঠলো, খাওয়ার মতন কিছু আছে?

আলিম বললো, ভাত আর ডাইল তো থাকনের কথা।

খেসারি কলাইর ডাল আর ঠাণ্ডা ভাত ক্ষুধার্ত পেটের জন্য কোনো সমস্যা নয়। এইই যেন তাদের কাছে অমৃত মনে হয়।

খাওয়ার পর হুঁকো টানার অভ্যাস হোসেন মৃধার। তাই এখন ভরা পেটে কেমন উসখুস করতে থাকে সে। আর তা দেখেই হাসন আলি হেসে উঠে বলে, বাজান, সামনের দিগে যাও, কয়জনরে দেখবা তামুক টানতাছে। পানি ছাড়া হুক্কা!

খাওয়া শেষে ক্লান্ত নারী তিনজনেরই প্রচণ্ড ঘুম পায়। খড়ের উপর শুয়ে পড়ে চান্দভানু বললো, হাসন আলি, আলিমরে নিয়া আমগো কাছেই থাক বাজান!

আলিম বললো, আপনেরা ঘুমান। আমরা দুইজনেই পাহারায় আছি!

দলে নারী সদস্য আসার কারণে হাবিলদার কাশেম খুবই বিরক্ত হলেন। হাসন আলির দিকে উত্তপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এরারে নিয়া তো বিপদ আরো বাড়াইলা হাসন!

বিপদ আর কি হইবো মুরুব্বী? হাসন আলি বিনয় প্রকাশে সতর্ক থাকে। এই প্রবীন স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে দেশ মুক্ত করার অভিপ্রায়ে ছেলেদের বিভিন্ন অস্ত্র চালনা শিখাচ্ছেন। এ না হলে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া, ফিরে আসার মাঝখানে হয়তো তার মা-বাবা আর বোনেরও আরও বড় বিপদ ঘটতে পারতো। সে আবার বললো, এরা তো বিপদে পইড়াই আছে!

আমি হেইডা কইতাছি না! হাবিলদার কাশেম হাসন আলির কথার পিঠেই যেন যুক্তি তুলে ধরতে চাইলেন, তোমার বাপ-মা আর বইন থুইয়া কি অপারেশনে যাইতে চাইবা?

হাসন আলি টানটান হয়ে বলে, ঠিক করছি এরারে ট্রেনিং দিয়া নিজেই কমান্ডার হমু!

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও শেষে আলিম বক্সের দিকে ফিরে হাবিলদার বললেন, আলিম কি কও? তোমার কি মনে কয় এরা কিছু করতে পারবো?

যা হুনছি, আমার মনে কয় এরা ট্রেনিং পাইলে ভালো ফাইটার হইবো! বলে, আলিম বক্স ফের জানায়, তিনডা মাইয়া মানুষ আর একটা পুরুষের কথা হুনছেন না, এরাই হেই চাইরজনের দল!

এবার বৃদ্ধ হাবিলদারের অভিজ্ঞ চোখ চকচক করে উঠতে দেখা যায়। মুহূর্তেই যেন রাগী রাগী চেহারায় ফুটে ওঠে এক ধরনের প্রসন্ন ভাব। খুশি খুশি কণ্ঠে বলে উঠলেন, ভালো! ভালো! খুবই ভালো! এরারে তাইলে কমান্ডো ট্রেনিং দিমু!

তারপরই খানিকটা বিষন্ন কণ্ঠে হাবিলদার কাশেম বলে উঠলেন, মতিউর রহমানের বাড়িত তো মিলিটারি আইয়া ভইরা গেছে। গুলি-গোলাও নাকি জমাইতাসে। তাগো কিছু আইজ রাইতেই যাইবো পান্তার বাজারে। কিছু ঘাঁটি কইরা থাকবো ইস্কুল ঘরে। কিন্তু কিছুডা অ্যামুনিশন কব্জা করতে পারলেও হইতো। আমাগ কাছে যা আছে তা দিয়া বেশিক্ষণ ফাইট দেওন সম্ভব না!

আলিম বক্স বললো, দেলু আর ফালু তো কইছে কিছু না কিছু চুরি কইরা আনতে পারবো।

ধুর! হাবিলদার কাশেম পাত্তা দেন না সে কথায়। বললেন, তারা চুরি করছে ঘটি-বদনা। এত বড় কাম তারা করবো হেই আশা করা অন্যায়!

দেলু আর ফালু পেছন থেকে কথাবার্তা শুনছিলো। তাদের প্রসঙ্গ উঠতেই ফালু বলে উঠলো, কাইল-পশশু যদি কিছু আনতে না পারি তাইলে আমরারে বাইন্দা থুইয়েন!

হাবিলদার বিরক্ত হয়ে বললেন, যা যা! ঘটি-বদনি চুরি করগা! দেশ স্বাধীন হইলে বেইচ্যা বড়লোক হইতে পারবি!

পরদিন ভোর হতেই চান্দভানু, জুলেখা আর মমতার প্রশিক্ষণ শুরু হয় হাসন আলির কাছে। আর হোসেন মৃধার দায়ীত্ব পায় আলিম বক্স।

দেখা যায় ছোটছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন হাবিলদার কাশেম। নির্দেশ থাকলো যতটা সম্ভব প্রতিপক্ষ গুলি খরচের সুযোগ যেন না পায়। এ অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য অস্ত্র সংগ্রহ। গত পরশু দিনের অপারেশনে তাদের সংগ্রহ বেশ ভালো হয়েছে। বিশটি অস্ত্রের মাঝে চায়নিজ রাইফেলই পাওয়া গেছে আটটি। বারটি থ্রি নট থ্রি। বুলেটও পাওয়া গেছে বেশ। আর এতেই দলটির শক্তি আর সাহস বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলা যায়। তা ছাড়া দিন কয়েকের ভেতরই কিছু গ্রেনেড আর গুলি আসার কথা পান্তার বাজার এলাকার মুক্তিযোদ্ধার দলটির কাছ থেকে।

বিভিন্ন দলকে দায়ীত্ব ভাগ করে দিলেও হাসন আলি বা আলিম বক্স কোনো দায়ীত্ব পাচ্ছে না দেখে দুজনেই বললো, আমরা কি কোনো কাজ পামু না?

হাবিলদার কাশেম চিন্তিত মুখে বললেন, তোমরার ট্রেনিঙের অবস্থা কি?

আলিম জানায়, মোটামুটি যুদ্ধ করতে পারবো!

মোটামুটি হইলে তো হইবো না! আমি ঠিক করছি তোমরার ছয়জনের গ্রুপটার প্রথম অপারেশন হইবো মতিউর রহমানের বাড়ি। মতিউর রহমান হাসন আলির মামু। অন্যরা তোমরারে খুব বেশি বিশ্বাস করতে পারতাছে না।

কথা শুনে হাসন আলির মন খারাপ হয়ে যায়। সে ব্যথা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, আপনে বিশ্বাস করেন ওস্তাদ?

হাবিলদার কাশেম মাথা নেড়ে বললেন, আমি তোমরারে চিনি। তাও জনগণ বইল্যা কথা। হোনো নাই, রামে বিশ্বাস করলেও দেশের জনগণের অবিশ্বাসের কারণে সীতার সংসার করা হইলো না!

হাসন আলি বলে উঠলো, তাইলে অপারেশনের রাইতে আমরা আগে যামু!

হাবিলদার কাশেম একবার হাসলেন। কিন্তু হাসন আলির কথার জবাব না দিয়ে বললেন, একসপ্তাহ বাদে পান্তার বাজারে মুক্তিবাহিনীর আরো একটা বড় দল আইতাছে। হুনছি ইস্কুল ঘরের কিছু পাইক্যা যাইবো পান্তার বাজারে। আর হেইদিনই আমরা মতিউর রহমানের বাড়ি আর ইস্কুলঘর দখল করার আশা রাখি। কিন্তু তার আগে তোমার দলের ট্রেনিং কেমন হইলো একবার দেখন দরকার।

তখনই হাসন আলি বলে উঠলো, কাইলই দেখেন!

হাবিলদার কাশেম কিছু ভেবে নিয়ে বললেন, কাইল না! পশশু। এই দুই দিনে যত বেশি পার টার্গেট প্র্যাকটিস করাও। গ্রেনেড মারনটা ভালো কইরা দেখাও!

(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১২

You must be logged in to post a comment Login