জুলিয়ান সিদ্দিকী

মানব জনম

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

জানালার ও পাশে একটি চড়ুই বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চিড়িক চিড়িক করে ডেকে যাচ্ছে। শব্দটা প্রথম প্রথম ভালই লাগছিল টুটুলের। একা একা ঘরের ভেতর খানিকটা হলেও একাকীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পথ আবিষ্কার করে স্বস্তি বোধ করছিল কিছুটা। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেলেও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ডাকাডাকির কারণে চড়ুইটার ওপর বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল। এক সময় চিড়িক চিড়িক শব্দটা কানে এলেই মাথার ভেতর কেমন ঝনঝন করে উঠতে লাগল। বার কয়েক হুশ-হাশ করেও চড়ুইটাকে তাড়াতে পারছিল না সে। বরং তার মনে হচ্ছিল চড়ুইটা আরো জোরে আর ঘনঘন ডাকতে আরম্ভ করেছে। সে আবার শব্দ করে চড়ুইটাকে তাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফল হয় উলটো। চড়ুইটা ঘাড় কাত করে টুটুলের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরই আবার ডাকতে আরম্ভ করল। যেন বুঝতে পারল তার অসহায় অবস্থা। আর যাই করতে পারুক, জানালার বাইরে এসে তার পক্ষে ভয় দেখানো সম্ভব না। একটু পরপর টুটুলের দিকে তাকিয়ে বেশ শব্দ করে ডাকতে থাকল চড়ুইটা। টুটুলের অসহায় অবস্থা দেখে যেন খুব মজা পাচ্ছে চড়ুইটা।

খাটের পাশে কাঠের টুলটার ওপর সকালের চায়ের কাপটা ছিল। হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে ছুঁড়ে মারতে গিয়েও থামল সে। আর তখনই যেন চড়ুইটা দয়া করে উড়ে গেল।

যাক, উফ! মাথার ভেতরটা কেমন হালকা লাগছে। সে টেবিলে সামনে ফিরে এসে মনিটরের দিকে তাকায়। লেখাটা প্রায় অর্ধেকের মত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু চড়ুইটার অত্যাচারে সব ভাবনা-চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গেছে। কোনটার পর কোনটা লিখবে বলে ভেবে রিপোর্টটা আরম্ভ করেছিল তার ধারাবাহিকতাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল তুলে আনা লালন মেলার ছবিগুলো ফের একটার পর একটা সাজাল টেবিলের ওপর। সেই সঙ্গে নিজের চোখে দেখা মেলার দৃশ্যগুলো মনের পর্দায় নেড়েচেড়ে দেখছিল। ঠিক তখনই বদমাশ চড়ুইটা আবার ফিরে এসে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চিড়িক চিড়িক করে ডাকতে লাগল।

মেজাজ খারাপ করে টুটুল চড়ুইটাকে একবার দেখল। তারপর খবরের কাগজ পেঁচিয়ে লম্বা লাঠির মত বানিয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে চড়ুইটাকে ভাল মতই ভয় দেখাতে পারল। চড়ুইটা উড়ে গিয়ে বসল পাশের বিল্ডিঙের পানির ট্যাঙ্কের ওপর। তখনই সেখানে একটি কাক উড়ে এসে বসলে চড়ুইটাকে উড়ে যেতে দেখা যায় ঢেউয়ের ভঙ্গীতে। কিন্তু ঝামেলা পুরোপুরি বিদায় হলেও সে কাজে মন দিতে পারছিল না। অথচ বিকেল পাঁচটার ভেতরই অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে।

একবার তার মনে হয় বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু এ ফ্লাটে উঠে আসার পর যতবারই সে একা একা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ততবারই দেখতে পেয়েছে সামনের বিল্ডিঙের আট তলার একটি জানালায় গালে হাত দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে এক শেতাঙ্গিনী। চুলগুলো পাটের আঁশের মত হালকা সোনালী দেখায়। শেতাঙ্গিনীকে দেখতে পেলে বারান্দায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে সাহস হয় না টুটুলের। কী জানি, মহিলা মনে মনে তাকে হ্যাংলা ভেবে বসে কিনা। এমনিতেই শেতাঙ্গিনী দেখলে বাঙালী পুরুষদের মরা-গাঙ-হৃদয় শ্রাবণের নদী হতে দেরি হয় না এমন দুর্নামও আছে। অবশ্য পাশে নাজমা থাকলে তেমন কোনো সংকোচ বোধ করে না সে। তবে,সে সময় অবশ্য অই ভদ্র মহিলাকে জানালায় দেখা যায় না।

সে বারান্দার দিকে না গিয়ে চট করে কিচেনে ঢুকে পড়ে। চুলো জ্বালিয়ে একটি স্টিলের বাটিতে পানি নিয়ে সেটা আগুনের আঁচে বসিয়ে দেয়। নাজমাকে কতবার বলেছে একটি কেটলি আনতে। নয়ত সে নিজেই নিয়ে আসবে। কিন্তু নাজমা কখনোই তার কেটলির ব্যাপারটা সমর্থন করে না। বলে, কেটলি ভাল মতো পরিষ্কার করা যায় না। আর একজনের চা-কফির জন্য আলাদা কেটলির চাইতে একটি বাটি অনেক ভাল। হরেক রকম কাজে ব্যবহার করা যায়।

বাটিতে পানি ফুটতে আরম্ভ করলে কিছুক্ষণ পর চুলোর আগুন নিভিয়ে দিয়ে একটি কাপে গরম পানি নিয়ে কফির সন্ধান করে সে। কিন্তু অনেক খুঁজে পেতে কফির সন্ধান না পেয়ে চায়ের প্যাকেট থেকে একটি টি-ব্যাগ নিয়ে কাপের পানিতে ছেড়ে দেয়। হটাত কিচেনের জানালায় একটি সবুজ রঙের ঘুড়ি উড়ে এসে গ্রিলে ঠোকর খেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। এ সময় ঘুড়ি দেখতে পেয়ে অবাক না হয়ে পারে না সে। লেখাপড়ার পাট শেষ করে পত্রিকায় চাকরি নেওয়ার পর আকাশের দিকে কোন দিন তাকিয়েছে মনে করতে পারে না। অফিস, অ্যাসাইনমেন্ট, ঘর। এই তিনটি শব্দের গোলোক ধাঁধাঁয় আবর্তিত হচ্ছে তার জীবন। আর এই করে করেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছে হুহু করে।

কৌতূহলী হয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁকে উঁকি দিয়ে ঘুড়িটার অবস্থান দেখতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু সেটা কার্নিশে না আটকে থেকে হাওয়ায় ভেসে কোন দিকে চলে গেছে কে জানে!

চায়ে চিনি মিশিয়ে কাপ হাতে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই যেন আপনা আপনি তার দৃষ্টি চলে যায় আট তলার জানালায়। তখনই যেন সে হঠাৎ দেখতে পায় মহিলা হাত নাড়ল যেন। ব্যাপারটা বুঝতে সে ভাল মতো তাকায়। হ্যাঁ, মহিলা আবার হাত নাড়ল। তার মুখের হাসিও যেন দেখতে পেল টুটুল। কিন্তু বিভ্রান্ত হল না তেমন একটা। উপরে আরো ফ্লাট আছে। সেখানে বারান্দা বা জানালাও কম নেই, সেখানকার কারো উদ্দেশ্যেও মহিলা হাত নাড়তে পারে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে, আচ্ছা, মহিলার কি কোনো কাজ নেই? এখানেই বা বসে থাকে কেন? আজ হাত নাড়াতে দেখা গেল। একবার দুপুরের দিকে, আরেকদিন বেলা ডুবছে তেমন সময়ও দেখা গেছে গালে হাত দিয়ে বসে আছে মহিলা। আজ কেমন যেন খুশি খুশি দেখাচ্ছে। ফের চোখ তুলে তাকাতেই মহিলা হাত নাড়ল। তাহলে কি তাকে উদ্দেশ্য করেই হাত নাড়ছে? কেন? খানিকটা অবাক হয় টুটুল। ব্যাপারটা পরীক্ষা করতেই সে ঘরের ভেতর চলে আসে। এ ঘর ও ঘর করে চা পান শেষ করে সে আবার বারান্দায় যায়। আড় চোখে পাট-চুলো মহিলাকে দেখে। রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে নিচের রাস্তায় লোকজন, রিকশা আর গাড়ির চলাচল দেখে। এবার আড় চোখে তাকাতেই দেখতে পেল মহিলা দু হাতে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছে। সে যে টুটুলের আচরণে বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যায়। নাকি ভাবছে, একা একা একজন মানুষ একটি ফ্লাটে থাকছে, নিশ্চয় লোকটির মাথার স্ক্রু দু একটা ঢিলা না থেকে পারে না। রেলিং টপকে লাফিয়ে পড়াটাও হয়ত বিচিত্র কিছু নয়। আর এমন একটি ভাবনা মাথায় আসতেই তার দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হল। রেলিঙের ওপর একটি পা তুলে দিয়ে সে তাকায় সেই জানালার দিকে। এবার আতঙ্কিত মহিলা জানালার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে একটি হাত বের করে ইঙ্গিতে তাকে অমন করতে মানা করতে লাগল।

দৃশ্যটা দেখে হেসে ফেলে টুটুল। তাহলে মহিলা তাকে দেখেই হাত নেড়েছিল? ভারী আশ্চর্য তো! মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিঙে দরজা-জানালা আর বারান্দার সংখ্যা কম না। আর তার মাঝে কিনা এদিকেই চোখ পড়ল মহিলার? সে পা নামিয়ে হাসিমুখে মহিলার দিকে তাকালে দেখতে পেল, মহিলা এক হাত দিয়ে আরেক হাতে কিল মারার ভঙ্গী করে তাকে মার দেখাচ্ছে! মনে হল মার দেখানোর সময় চোখ দুটো পাকিয়ে রেখেছিল মহিলা। ব্যাপারটায় খুব মজা পেয়ে গেল সে। একবার ভাবল আবার এমন করবে কিনা। না থাক! পরক্ষণেই কাজের ভূত মাথায় চাপতে সে হাত নাড়ল মহিলার উদ্দেশ্যে। মহিলাও পালটা হাত নাড়ে তার উদ্দেশ্যে।

বারান্দা থেকে হাসতে হাসতে সে ফিরে আসে টেবিলের সামনে। আর তখনই তার মনে পড়ে যায় কোনটার পর কোন ছবি সাজাবে। চড়ুইটা বিরক্ত করার আগে কী কী লেখার কথা ভেবে রেখেছিল। বেশ প্রফুল্ল মনে কাজটা শেষ করতে পারল টুটুল। দীর্ঘ দিন পর আজ একটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে খানিকটা তৃপ্তি বোধ করল। কিছুক্ষণ পরই ফোনটা ক্রিকক্রিক করে বাজতে থাকলে প্রতিবেদনটা সেভ করে ফোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলতেই জমির হোসেনের কণ্ঠ শোনা যায়, তোর কাজের কদ্দুর?

টুটুল বেশ আয়েশি ভঙ্গীতে জানাল, আরে ভাই, কাজ কি আর অতক্ষণ পরে থাকে? ছবিগুলো আনলোড করে অ্যাড করা বাকি আছে। বললে বিকেলের আগেই পৌঁছে দিতে পারব।

-তাহলে তাই নিয়ে আয়।

-ঠিক আছে।

টুটুল বেশ প্রশান্ত মনে পেটের ওপর আঙুল নাচিয়ে বোল বাজাল কিছুক্ষণ। হাসপাতালে আজ বেশ কটা কেস আছে নাজমার। সবগুলো মেয়েলী ব্যাপার। দুজনেই কাজের চাপে এক হতে পারছে না সপ্তাহ দুয়েকের মত হয়ে গেছে। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে সে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলেও প্রকাশ করেনি। এদিক দিয়ে নাজমা বেশ বাতিকগ্রস্ত বলা যায়। শরীরের প্রয়োজনে শরীর ব্যাপারটাকে সে খুবই ঘৃণা করে। বলে, আরে বাপু আমরা মানুষ তো নাকি? জীব-জানোয়ার তো আর না! খানিকটা ধৈর্যই যদি ধরতে না পারলাম তাহলে আর মানব জনম কেন?

এমন কথা শুনলে আরো নির্বোধও হয়তো দ্বিতীয়বার কিছু বলতে সাহস পাবে না। তারপর থেকেই নাজমাকে মাঝে মাঝে আঁতেল ডাকে সে। আঁতেলরা সব কিছুই একটু বেশি বোঝে। তারা যে একেকজন একেকটি  জ্ঞানের টাওয়ার তা বোঝাতেই যেন কথাবার্তায় রাজ্যের জ্ঞান এনে জড় করে ঘন ঘন। নাজমা এমন আঁতেল হয়ে উঠবে জানলে কম বুদ্ধির কোনো গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করতো সে। জীবন আর সংসার অন্তত সাদা সিধে থাকতো। আঁতেলের সঙ্গে তর্ক বা আলোচনা চলতে পারে হয়ত, কিন্তু সংসার করাটা নেহায়েত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। কথায় আছে, যে গ্রামে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আছে, সে গ্রামে বাস করতে নেই। এদের অতি বুঝ অন্যের জন্যে যে কত বড় বোঝা, সেই জ্ঞান তাদের কোনো কালেই হয় না।

সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে নাজমাকে দেখতে পেয়ে মনটা খুব ভাল হয়ে গেল টুটুলের। খাটে শুয়ে শুয়ে মেডিক্যাল জর্নাল পড়ছে খুব মন দিয়ে। অথচ টুটুলের ইচ্ছে করছিল তাকে আদর করতে। বিড়ালের মতো নিজেও খানিকটা ওম নিতে। কিন্তু এখন সে বাইরে থেকে এসেছে। বাথরুমে গিয়ে শরীর ধুয়ে না এলে কাছেই ঘেঁষতে দেবে না।

বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে জলের ধারার নিচে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর শরীর মুছে বের হয়ে এসে মাথায় তোয়ালে ঘষতে ঘষতে বলল,আজ আমরা কী রান্না করব?

একই অবস্থায় থেকে চশমার কাচের উপর দিয়ে ঠিক মাস্টারনীর মত তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল নাজমা,খিদে কি খুব বেশি লেগে গেছে?

-ক’টা বাজে? বলে সে দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকায়। তারপর বলল, আর ঘণ্টা খানেকের ভেতরই লাগবে।

-তাহলে অনেক সময় আছে। বলে,শোয়া থেকে উঠে বসে নাজমা বলল,এখনো চুল মোছা হয় নি? ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে ফেল না!

-লাগবে না। হয়ে গেছে! বলে, তোয়ালেটা বাথরুমে রেখে আসে টুটুল। তখনই নাজমা তাকে হাতছানি দিয়ে বলল, এখানে এসে বসো! আমার একটা আর্টিকেল ছেপেছে। মাঝে মাঝে পড়ছি। শুনে বলবে কেমন হয়েছে!

টুটুলের হাই উঠতে নিলেও কোনো রকমে চেপে রাখে। নাজমার বিষয়গুলো খুবই নিরস আর বিটখিটে। তার ভাল লাগে না। তবু প্রতিটা আর্টিকেল সম্পর্কে তাকে মতামত দিতে হয়। ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে সে বলল, তোমার মেডিক্যালের সাবজেক্ট, আমি কী বুঝব?

খানিকটা বিরক্তি নিয়েই যেন তাকায় নাজমা। বলে, ভাষাটা তো বুঝতে পারবে। কেমন গুছানো হল তাও কি বুঝবে না?

-তুমি তো আমার চেয়ে ইংরেজি ভাল বোঝো!

-তবু।

তখনই টুটুল বলল, অনেকদিন দুজনে একসাথে কোথাও বের হতে পারি না। চল না, রাতের খাবারটা বাইরে খাই!

নাজমা চোখ পাকিয়ে বলল, এই, তুমি এত বেরসিক কেন?

-বেরসিকের কি হল? আমরা দুজন একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যেতে পারব না? বলেই নাজমার হাত ধরে টুটুল। চল, প্লিজ!

নাজমা মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও বিরক্তি দেখিয়ে বলল, তুমি না! তোমার ভেতরকার বাচ্চাটা আর বড় হল না!

নাজমার কথায় হেসে উঠল টুটুল।

-হাসছো কেন?

-ছেলেরা বাবা হতে না পারলে তো বাচ্চাই থাকে!

টুটুলের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে যায় নাজমা।

ব্যাপারটা খেয়াল করলেও টুটুল বলল, তুমি তৈরি হও। আমিও হচ্ছি।

টুটুল তৈরি হয়ে দেখল নাজমা তেমনিই বসে আছে। সে অবাক হয়ে বলল, কি হল?

-আমার ভাল লাগছে না!

-এরই মধ্যে মন খারাপ হয়ে গেল?

টুটুল এগিয়ে গিয়ে নাজমার হাত ধরে টেনে তোলে। চল, প্লিজ! তারপর তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি দিন দিন রোবোটের মত হয়ে যাচ্ছো। তুমি যে একটা মানুষ সেটাই হয়ত ভুলতে বসেছ। আগামী দিন গিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি চাইবে। তার পাঁচ দিন আমরা ঢাকার বাইরে থাকব।

টুটুলকে হটাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে গাল পেতে দিয়ে নাজমা বলল, আমিও কদিন ধরে তাই ভাবছিলাম।

-আহ! কত্তো ভাল মেয়ে তুমি! আমরা প্রথম প্রথম প্রতি মাসেই ঘুরতে যেতাম। আজকাল তুমি ঘর আর হাসপাতালের বাইরে কিছু ভাবতে পারো না! এক আধটু নিজের দিকে, আমার দিকে তাকালে কী ক্ষতি হয়?

-তুমি তো সবই দেখতে পাচ্ছ!

নাজমাকে ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি হয়ে আবার বলল টুটুল, কাপড় পালটাবে না?

-এক্ষুনি যাচ্ছি! বেশিক্ষণ লাগবে না।

মিনিট দশেকের ভেতর তৈরি হয়ে নিয়ে নাজমা টুটুলের হাত ধরে বলল, চল!

ঠিক তখনই দরজার বেল বেজে উঠল।

টুটুল এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখল একটি অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি চাই?

-আমি সাত তলা থেকে এসেছি। ডাক্তার আপু আছেন?

নাজমা এগিয়ে এসে মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে বলল, কি বাবুই? ভেতরে এসো! কিছু বলবে? বাবলি কেমন আছে?

-আপু বাথরুমে পড়ে গেছিল। রক্তে সব ভেসে যাচ্ছে!

সর্বনাশ! করেছে কি? বলেই এক ছুটে ভেতরে গিয়ে হাসপাতালের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ফিরে আসে নাজমা। টুটুলকে বলে, আমি আসছি! দরজাটা বন্ধ করে দিও!

নাজমা বাবুইর সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উপর তলার দিকে উঠে গেলে টুটুল দরজা বন্ধ করে দিয়ে ড্রয়িং রুমে ফিরে আসে মন খারাপ করে। ভাবে, এ কেমন সংসার হল তার? বাকি দিনগুলোও কি এভাবেই যাবে? মিনিট বিশেক পর দরজার বেল বাজতেই বেশ প্রফুল্ল মনে উঠে গিয়ে দরজা খোলে সে।

নাজমা টুটুলকে দেখে বলল, আমি বাবলিকে নিয়ে এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে অ্যাবরশান হয়ে যাবে! আজ ফিরতে পারি কিনা বলা যাচ্ছে না! তুমি খালি পেটে থেকো না কিন্তু। কিছু একটা বানিয়ে খেয়ে নিও! ফ্রিজে সবই আছে।

তারপরই দ্রুত পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে থাকে নাজমা। টুটুল ভাবছিল, নাজমা বুঝি একটু থামবে। একবার মাথা তুলে উপরের দিকে তাকাবে। কিন্তু একবারও তাকায় না নাজমা। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে নামতে এক সময় দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়।

২১.৩.২০১১

***(নতুনদেশ-এ প্রকাশিত।)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


9 Responses to মানব জনম

You must be logged in to post a comment Login