এ ব্রিফ ডাইরি অফ হারিকেন আইরিন
২৫ আগস্ট, ২০১১
—————
নিউ ইয়র্ক হাতে হারিকেন নিয়ে উড়িতেছে। নো বাস। নো ট্রেন। নো প্লেন। নো ক্লেইম। বুঝলা বাপা, আইরিন ইজ কামিং। আইরিন আসিতেছে। লে লে লে হালুয়া।
–আইরিন ক্যাডা?
–মিস আইরিন।
এই পর্যন্ত শুনিয়া বেঞ্জামিন বেনী দাঁড়াইয়া গেল। বেনী টলিতেছে। এখন তাহার টলিবার সময়। বেনী মাথাটি একটু ইষৎ ঝুকিয়া পড়িল—বোঁ করিয়া কহিল, মিস আইরিন ইজ সেক্সিয়ার দ্যান মিস সাকিরা।
সাকিরা গাহিয়াছে, হিপ ডোন্ট লাই। সাকিরা বেনীর দেশি। কলাম্বিয়ার মেয়ে। গৃহহীন বেনীর প্রিয় বন্ধুও বটে। সুতরাং বেনী কখনো মিথ্যা কথা বলিতে পারে না। বেনী ইজ অলঅয়েজ রাইট। আইরিন নামে ঝড় আসিতেছে—তাহা মোটেই ঝড় নহে, কড় কড় নহে, ফড় ফড়ও নহে। তাহা মিস আইরিন নাম্মী এক সেক্সি লেডি। ঘাগরা তুলিয়া বেলি ড্যান্স দিতে পারে। গাহিত পারে—হাওয়ামে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মল মল ও যায়ে…।. নিউ ইয়র্ক এই গান শুনিয়া ড্যান্স দেখিয়া ভাবের ঘোরে উড়িতেছে। আর বেনী ঢুকু ঢুকু রামের বোতল চুমিতেছে। তাহার সাকিরা আসিবে। তাহার শূন্যজীবনে পূন্য করিয়া দিবে। প্রথমবারের মত কোনো রমনী কহিবে–হাই ডার্লিং। আই লাভ ইউ।
২৬ আগস্ট, ২০১১
—————-
লোপেজের মাথা খারাপ। নতুন গাড়িটা নিয়ে ছুটে এসেছে। ধা করে ছুটে এসে বলেছে, রায়, তুমি কি ফিওনাকে দ্যাখছো?
ফিওনা চেয়ারের উপরে ঠ্যাং তুলে টেক্স মেসেজ করছিল। মুখ না তুলেই আওয়াজ দিল, হেরে কেরে ক্যাট ক্যাট।
লোপেজ ফিওনার ঠ্যাঙ্গে হামলে পড়ল, এলেনা খবর পাঠাইছে। বুঝলি ছুড়ি। এলেনা খবর দিছে।
ফিওনা উঠে খাড়াল। একপাক নেচে বলল, কী খবররে ব্যাটা। এইরকম? আমার ড্যান্সের মত?
লোপেজ জিব কেটে বলল, আও ছি। এরকম বলে না মেরেজান। শি ইজ মাই এক্স ওয়াইফ। তারে আমি মিস করি।
–হ্যায় কি কইছে হেইডা কইয়া ফ্যালা মাউড়ার পো। বেশি ভ্যাড় ভ্যাড় করিস না।
লোপেজ ফোন থেকে এলেনার ছবি বরে করে দেখাল। এলেনা হাসছে। আর লোপেজ কাশছে। পঁচিশ বছর আগেকার ছবি। চুক চুক করে চুমু খেলে। ফিওনা বলল, আমার চাইয়াও সুন্দর রে হেই নটি গার্ল?
–তুমি অইলে সুন্দর না, সুন্দরের মা। কইতে পার সুন্দরের খুড়ি মাও।
শুনে ফিওনা জব্বর খুশী। লোপেজকে ধরে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেছে। নাচ থামিয়ে লোপেজের ইনবক্স থেকে পড়ছে, এলেনা মেসেজ দিয়েছে, ডার্লিং লোপেজ, জরুরী জিনিসপত্র কিইন্যা স্টক করো। শুকনো খাবার, পানির বোতল, ফ্লাশ লাইট, ম্যাচ লাইট, মোমবাতি, টিস্যু পেপার, জুস, ওসুদপত্তর ইত্যাদি ইত্যাদি।
লোপেজ পড়ে মিচকি মিচকি করছে। আর ফিওনা মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে, খাসা বলছে। বেড়ে বলছে। ভাল বলছে। লক্ষ্মী মাইয়া। এই মাইয়ার তুলনা নাই।
সুতরাং লোপেজ ছুটল গ্রোসারীতে। সঙ্গে ফিওনা। গ্রোসারীতে লম্বা লাইন। তার আগামাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। গাড়ি নিয়ে এ গ্রোসারি থেকে সে গ্রোসারিতে যায়। সবটাতেই ভিড়। ঠেলে ঢোকা যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এই ভিড় দেখেই দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্তি দূর করার জন্য একটা মদের দোকানে ঢুকলো। সেখানে কোনোক্রমে ঢুকে দুজনে দুবোতল গিলল। গিলে দুজনের মনে হল—এখন মদ সংগ্রহ করাটাই ইমারজেন্সী। তারা গাড়ি ভর্তি করে মদ স্টক করে ফেলল। লোপেজ বলল, আর চিন্তা আছে।
–নো। এভিরি থিং ইজ অলরাইট। আসুক হারিকেন। আমাগো আর টেনশন নাই। প্রিকওশন নেওয়া শেষ। তবে?
–তবে কিগো ডার্লিং?
–একটা বাইবেল কেনন দরকার।
–বাইবেল কিন্যা লাভ কি। তার চাইয়া চল একটা চার্চ কিন্যা ফ্যালাই।
ওরা দুজনে মদ গিলতে গিলতে চার্চের খোঁজ করতে লাগল।
এর মধ্যে সন্ধ্যাসন্ধী গ্রোসারীর স্টকও শেষ। লোকজন কিনে কেটে বাড়ি ফিরে গেছে। গ্রোসারিগুলোতে ঝাপ পড়ে গেছে। আর এ সময়ের মধ্যে যারা কেনে নাই তাদের হাতে সত্যি সত্যি হারিকেন।
২৭ আগস্ট, ২০১১
—————
আকাশটা গুমোট। গরম গরম লাগতেছে। ছিটে ছিটে বৃষ্টি হইতাছে। ওকাম্পো নামের মেয়েটা রাস্তায় ব্যাগপ্যাক নিয়ে অপিক্ষা করতেছে। তার বন্ধুর গাড়ি নিয়া আসনের কথা। হ্যার খবর নাই। হালায় কি অন্য মাইয়ার লগে কি অন্য স্টেটে পালাইলো? ওকাম্পো তাইলে অখন কি করে?
এর মইদ্যে আলেক্স আইসা পড়ছে। ওকাম্পোরে দেইখা কয়, হ্যাল্লো মেরেজান। খাড়াইয়া আছ ক্যান?
–ইভাকুয়েশনে যামু।
–তাইলে দেরী কইরো না। আইসা পড়।
ওকাম্পো ব্যাগপ্যাক নিয়া আলক্সের গাড়িতে উইঠা পড়ল। তার পেয়ারা জানেমনের আসনের কথা ভুইল্যা গেল। আলেক্সের গালে চুম্মা খাইয়া বলল, তাইলে আমরা বাঁচতেছি।
–বাঁচতেও পারি। নাও বাঁচতে পারি। হেইডা নিয়া চিন্তা কি? হেইডা নিয়া চিন্তা করবো প্রভু যীশু আর সরকার। গভর্নমেন্ট। গাড়ি উড়ে চলল মল মল কইরা।
হেয়ার মইদ্যে সিমন ফোন দিল। বলল, রায়, তুমার কাছেপিঠে কি ট্রয় ভেস্টরে দ্যাখছো?
–হ্যারে দিয়া অহন কি করবা?
–হ্যারে দরকার। আইরিন তো আমাগো মাইরা ফেলাইবে। হ্যার আগে ভেস্টের লগে আখেরি মহব্বতটা সাইরা লই। আর চান্স তো পামু না জান।
ভেস্ট নাই। সে ব্যাটা কোন কুঞ্জবনে আছে হ্যার খবর হ্যায় নিজেও জানে না। জাইনা লাভ কি। আইরিন আইতাছে। হগ্গলের ল্যাঞ্জায় হারিকেন জ্বালাইয়া দেতেআছে। বাই সিমন। টেক কেয়ার বেবি।।
দুপরের মইদ্যে বাস ট্রেন বন্ধ হো গিয়া। বৃষ্টি পড়তাছ ঝিরিক ঝিরিক। রাস্তা দিয়া প্রাভেট কার হুসহাস কইরা বারাইতেছে। লোকজনে টেলিভিশনের সামনে হুমড়ী খাইয়া বইসা আছে। আর প্রভু যীশুর যশোগান করতাছে। তিনিই জীবন। তিনিই পথ। তার পথে হাটন ছাড়া উপায় নাই।
পাকিস্তানী সোহেল শফি একটা টেক্সি ক্যাব লইয়া আইছে। আইসা কয়, বোঝলা রায়, কোমে লুদ আইতাছে। দজ্জাল আইতাছে। আল্লা আল্লা কর।
–কোমে লুদ কেডা? আর দজ্জাল কেডা? হ্যারা কি ইভাকুয়েশন পার্টি?
–নারে বাপা। আম্রিকা গে ম্যারিজ চালু করছে। আর গাদ্দাফিরে তাড়াইতেছে। আল্লায় খেইপা লাল। কইছে, ওরে কোমে লুদগণ আম্রিকায় যাও। ওহে এক চোখা দজ্জাল নিউ ইয়র্কে যাও। কেয়ামত নামাইয়া দাও। কুফরীগো মাইরা ফাতা পাতা কইরা দ্যাও।
তখনতো পরলউকে ইলকেট্রিসিটির লোড শেডিং চলতেআছে। কোমে লুদগণ কহিল, এই আন্ধারে যাই ক্যামনে?
দজ্জাল কইল, ক্যান হারিকেন আছে না। হারিকেন লইয়া চল। মহাবেপদ।
শুনে বুড়ো ফ্রাই দজ্জাল দজ্জাল করতাছে। আর কমেলুদের উদ্দেশ্য প্রার্থনা ধরছে, বাপা কোমেলুদ, বুইড়া কালে আমারে আর মাইরো না। ক্ষ্যান্ত দিও গো নাতি।
রাত বারোটার আগে মেয়র ব্লুমবার্গ দুই দুইটা ভাষণ দিয়া ফালাইছেন। ইংরেজি আর স্প্যানিশে। কইছেন, যারা পালান নাই, হ্যাগো পালানোর আর দরকার নাই। ঘরে থাইকেন। বাইরে আমাগো লোকজন আছে। হ্যারা খোঁজ খবার লইতাছে। নো প্রবলেম। আমি আপনাগো লগে জাইগা আছি। ঘুইরা ঘুইরা নিজ চইক্ষে দেখতাছি। রাইত চারটায় হারিকেন আইসবে।
রাস্তায় পুলিশের গাড়ি। এম্বুলেন্স। পুরা আতঙ্কের নগরী। গা ছম ছম করে গো।
রাত ১২.০১, ২৮ আগস্ট, ২০১১
——————— ————
বৃষ্টি হচ্ছে নানা কিসিমের। আমার বড়ো মেয়েটা নতুন কেনা টর্চ লাইটটা বারবার জ্বালাচ্ছে। আর ছোটো মেয়েটা মোমবাতি ধরিয়ে হাসছে। তার দীপাবলী দীপাবলী লাগছে। বলছে, লাইট ফ্যাস্টিভেল করছি। ভালো না বাবা?
মেয়ে দুটো জেগে আছে টর্চ লাইট আর মোমবাতি নিয়ে। ওদের মা বাথটাব জলে ভরে রেখেছে। তখনো আমাদের ইলেকট্রিসিটি ইন্তিকালে যায় নাই। ম্যানহাটন আর ব্রুকলিনে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ রাখছে। সাগর এলাকায় কিছু কিছু জল উঠছে। তার মধ্যে সাংবাদিকরা লাইভ টেলিকাস্ট দেখাচ্ছে। আর লং আইল্যান্ডে বাতাসে গাছ নড়ছে। আমিও নড়তে নড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত চারটায় বড় মেয়েটা ডেকে তুলল। বলল, হারিকেন শুরু হইছে। মেয়েটা ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। মোমবাতিও জ্বালায় না। টর্চ লাইটও বন্ধ। হাতে রসুনের কোয়া। বললাম, লাইট জ্বালা।
বড় মেয়ে বলল, লাইট জ্বাললে তো বাইরের হারিকেন দেখতি পারব না। হারিকেন হাতে ভ্যাম্পায়ার আইরিনকে দেইখা লই।
–হাতে রসুন ক্যান?
–রসুন থাকলে ভ্যাম্পায়ার আসতি পারে না। পলাইয়া যায়। ভ্যাম্পায়ার খুব খারাপ। রক্ত চুইষা খাইতি পারে না।
আমার বড় মেয়েটি এই ঝড়জলের মধ্যে হাতে রসুনের কোয়া নিয়ে জানালার কাছে বসে আছে। নিউ ইয়র্কের ঝড়জল হারিকেন ওরফে আইরিন দেখতে চেষ্টা করছে। আইরিন নামের এক ভৌতিক ভ্যাম্পায়ারকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
আমাদের দেশের কালবৈশাখির মত শো শো করে আওয়াজ হচ্ছে। গাছের ডাল নড়ছে। পাতা পড়ছে। এরকম ঝড়বাতাস আমাদের দেশে বছরে গণ্ডায় গণ্ডায় আসে যায়। সরকার ঘুমায়। আর জনগণ কলে পড়া ইঁদুরের মত ছুটে বেড়ায়–পোকামাকড়ের মত মরে।। আবার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনলাম, ছোটে মেয়েটা গলা খুলে গাইছে, ওরে ঝড় নেমে আয়, আয়।
সকাল ২৮ আগস্ট, ২০১১
———————-
সকাল আটটায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ডানকিন ডোনাট খোলা। অন্যসব দোকানপাট বন্ধ। এককাপ মিডিয়াম কাপ রেগুলার কফি কিনলাম। তিনটে চিনি। আর মিল্ক। সঙ্গে গরম গরম ডোনাট। খেতে খেতে দেখি, বাতাস হচ্ছে। বাতাসে মাঝে মাঝে উড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু নেয় না। বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা মেলা যায় না। মাথায় পলিথিন প্যাকেট বেঁধে পরীর পার্কের কাছে পোছে যাই। পরীর গায়ে গাছের ছোটো ছোটো ডাল। আর ঝরে পড়া পাতা। এর মধ্যে জল পড়ছে। পার্কে একজন লোক দিব্যি গুটি গুটি হয়ে শুয়ে আছে। তাকিয়ে দেখি, আমার বন্ধু বেঞ্জামিন বেনী। আমাকে দেখে বলছে, ওরে ছোড়া, হারিকেন কি অখনো জ্বলতেছে?
হারিকেন নিভিয়া গিয়াছে। জ্বলিয়া উঠিবার সময় পায় নাই। শুনিয়া বুড়ো বেনী হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে ফের নাক ডাকিতে শুরু করিয়াছে। ঘাসের মধ্যে তাহার রামের বোতল গড়াগড়ি খাইতেছে। আজ তাহার মিস আইরিন আসিবে না। ভালবাসিবে না। জাগিয়া থাকিয়া লাভ কি! এ জগতে কে কাহার?
বাই।
6 Responses to এ ব্রিফ ডাইরি অফ হারিকেন আইরিন
You must be logged in to post a comment Login