অনুবাদ গল্প: “সত্য”
ইরাকি উপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার ফু’য়াদ আল-তাকারলি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে বহুবছর ধরে সেখানেই বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে ইরাকের অন্যতম ফিকশন লেখক হিসেবে গণ্য করাহয়, বিচারক হিসেবে কাজ করার সময়কার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তার বেশীর ভাগ কাজের রসদ সংগ্রহ করেন। এবং তিনি প্রধানত লেখার মধ্যদিয়ে যৌন নৈতিকতা মূলক সমস্যা সমূহের—বিশেষ করে নিকট আত্মীয়দের দ্বারা সৃষ্ট যৌন নির্যাতনের— বিশদ বর্ণনা তুলে ধরেন। তার ছোটগল্প সংগ্রহ, দ্যা আদার ফেইস, এর দুটি সংস্করণ বের হয়, এর মধ্যে প্রথমটি ছাপা হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৮০ সালে তার প্রথম উপন্যাস, দ্যা রিমোট ইকো, ছাপা হয়, এবং এটি ফরাসীতে অনূদিত হয়। এছাড়াও তার আরো দু’টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, দ্যা সিল অব স্যান্ড (১৯৯৫) এবং জয়েস এন্ড হার্টএক (১৯৯৮)। ১৯৯৯ সালে তিনি ফিকশন লেখক হিসেবে খ্যাতনামা পুরষ্কার ‘হোয়েজ জয় করেন।
The Truth
সত্য
হ্যাঁ, ইয়োর অনার, এটা ঠিক। প্রথমবার আমি সত্য কথা বলিনি। মাস খানেক বা তারও বেশী সময় আমি মুখ বুজে ছিলাম। কিন্তু তখন, পুরোটা সময় আমি জেলে ছিলাম। আর আপনিই ভালো জানেন যে সম্মান সবার কাছেই প্রিয় এবং কারো কারো পক্ষে অনেক সময় এটাও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়না ঠিক কখন তাকে সত্য বলতে হবে। ইয়োর অনার, আমি নির্দোষ। আমিই আমার ছোট ভাইয়ের বউ, ফারাহকে খুন করেছি, কেননা সে ব্যভিচার করেছে। আমি তার এধরনের কাজে অবাক হয়েছি এবং আমি আমার আরব আত্মসম্মানের কাছে বশীভূত হয়েই এমন কাজ করেছি। এটা ঠিক, আমি তখন বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের কাছে আত্মসম্মানের মূল্য অনেক বেশী, এবং পরিবারের সম্মান হানি হলে সেটা রক্তের বিনিময়ে রক্ষা করাই আমাদের প্রথা। আমি আমার শিকারের রাইফেলে গুলি ভরি, যেটা এখন সবাই আপনার সামনে দেখতে পাচ্ছে; ব্যভিচার করায় আমি তাকে গুলি করেছি। এখন সেই প্রেমিক সম্পর্কে আপনাদের সবার কাছে খুলে বলার অনুমতি চাইছি।
এটা সত্য যে আমি তাকে ওর সঙ্গে দেখিনি। সেদিন, ভোরে, ফারাহ পরিবারের সবার জন্য নাস্তা তৈরি করতে তার ঘর থেকে বের হয়। তখন তার পড়নে ছিল সাদা ফোটা ওয়ালা একটা লাল জামা। আমি তাকে উঠানে চুলায় রুটি সেকতে দেখি। সে আমাকে বলেছে সে পাপ করেছে, সে ব্যভিচার করেছে; সে বলেছে সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে। তাই চুলা জ্বালিয়ে, তারপর সেটার আগুনে গুলি ফেলে আত্মহত্যা করতে সীসার কিছু গুলি চুলার মধ্যে ফেলেছে। ইয়োর অনার, একথা শুনে আমার ধমনীর রক্ত তেতে ওঠে। ওর দিকে রাইফেল তাক করে সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়ি। ও মুখথুবড়ে পড়ে মরে পড়ে থাকে।
স্যার, আমাদের কাছে আমাদের সম্ভ্রম অনেক দামী জিনিস, কেননা আমরা সত্যিকারের আরব। আমরা আমাদের পরিবারের সম্মান ধূলায় মিশে যেতে দিতে পারিনা। ব্যভিচারিণীকে হত্যা করাই আমাদের সনাতন প্রথা; এটাই আমাদের রীতি, এধরনের কাউকে আর আমাদের মাঝে বাঁচতে দেয়া হয়না। আবর্জনার মতো এধরনের মেয়ে লোকেদের অপসারণ করা হয়।
ফারাহ আমাকে আপনা থেকেই বলেছে, ইয়োর অনার, যে সে বাসর রাতের বিছানাতেই তার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে; পুলিশ কর্তৃক তার আটকের সুযোগে সে তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হয়ে, তাকে অন্ধকার হবার পর আসতে বলেছে। পরিবারের সম্মান রক্ষা ছাড়া আমি খুব বেশী কিছু করিনি। তার স্বামী আমার ভাই, এবং ও আমার খালাতো বোন। ও নিজের রূপ-লাবণ্যে তার প্রেমিককে অবৈধ মিলনে প্রলুব্ধ করেছে। হ্যাঁ, স্যার, ওর বয়স মাত্র উনিশ, দেখতে খুবই সুন্দর, একেবারে মধুর মতো। আমার সৎ-বোন হালিমা এর মধ্যে ছিলোনা। পবিত্র গ্রন্থ ছুঁয়ে আপনার সামনে আমি শপথ নিয়েছি। এটা সত্য, সে তখন আমার বাড়িতেই ছিল, কিন্তু এর কোন কিছুতেই সে অংশগ্রহণ করেনি, কেননা সেসময় সে সেখানে ছিলোনা। সেছিলো বাড়ির অন্য দিকে। বাড়িতে আমরা কিভাবে জীবন যাপন করি সেটা এর আগে একটু বলে নেই। আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভালো না, একটাই মাটির ঘরে কয়েকটা মাত্র কক্ষ। পুবের দিকের কক্ষে থাকে আমার ভাই ব্যভিচারিণী ফারাহ’র স্বামী ‘আব্দ আল-হামজা। এর পরই আমার মায়ের ঘর, তার পাশের কক্ষে আমি আমার নিজের পরিবার নিয়ে থাকি।
হ্যাঁ, ইয়োর অনার, আমি বিবাহিত, আজ দশ বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে আর আমার চারচারটি ছেলেমেয়েও রয়েছে। আমি সেনাবাহিনীতে কর্পোরাল পদে চাকুরী করি; এর আগে আমি কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইনি এমনকি কোন ধরনের অপরাধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবার চেষ্টাও কখনও করিনি। আমার সৎ-বোন হালিমার ঘরের পাশে উঠানের মাঝামাঝি চুলাটার অবস্থান। হালিমার নিজের ঘরটা খুবই ছোট। এসব কথা আমি কোর্টকে বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। যেদিন এই ঘটনা ঘটে, আমার বোন, হালিমা, এসে সেদিন আমার ঘুম ভাঙ্গায়। যদিও বলতে গেলে আমি একপ্রকার জেগেই ছিলাম; মনে হয় এর আগে নুরিয়া খালা, আমাকে ডেকেছিল। সে রাতে নুরিয়া খালা ফারাহ’র সঙ্গেই ছিল। সেই মনে হয় প্রথম গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে সবাইকে সেটা জানিয়ে ছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে আমি সেখানে ফারাহকে দেখতে পাই। সে তখন চুলার কাছেই মাটিতে শুয়ে ছিল আর সেটার ভেতরে সমানে গুলি বিস্ফোরিত হচ্ছিল। সেখান থেকেই গুলির শব্দ আসছিল। হ্যাঁ, আগেও আমি মাজিস্ট্রেটদের সামনে একথা বলেছি, ইয়োর অনার, কিন্তু সেটা সত্য ছিলোনা। তখন আমি ভুলে গিয়ে ছিলাম আর এবার আপনার সামনে সে কথা আবারও বলছি; আমার এই ভুলোমনের জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। হঠাৎ করেই আমার জীবনে এই ট্রাজেডি ময় ঘটনা ঘটেছে, তাই সে সময় যা মনে এসেছে তাই আমি বলেছি। কিন্তু সত্য কখনও লুকানো যায়না; দুর্ভাগ্যজনক হলেও একে দূরে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়।
এবার আসল ঘটনা শুনুন, ইয়োর অনার। সেই রাতে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন আমার বোন, হালিমা, ভোর চারটা কি পাঁচটার সময় আমার কাছে আসে; ও এসে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে, ফিসফিস করে বলে, কোন একজনকে সে উঠানের ওপর দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখেছে। আমি উঠে আমার নিজের পরিবারের কক্ষে যাই। ওরা তখন সবাই ঘুমিয়ে ছিল। তারপর আমি সেই খুন হওয়া ফারহ’র ঘরে যাই, সেখানে তখন সে একাই ছিল। আমার বোন, হালিমা, সতের বছরের তরুণী, খুবই ধারালো মেজাজের; এরই মধ্যে সে আপনার সামনে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে, আমার বিশ্বাস সে ঐ মৃত ফারাহকে অচেনা সেই লোকের সঙ্গে একই বিছানায় শোয়া অবস্থায়, ওদের যৌন মিলন দেখেছে, এবং একারণেই সে আমাকে জাগাতে আসে। স্যার, আমি তখন কাপড় চোপড় পড়ে সেই ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে আসি। ফারাহ তখন চুলায় সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল। হ্যাঁ, ইয়োর অনার, আসলে এভাবেই ঘটনা এগোচ্ছিল। সেদিন আকাশটা ছিল পরিষ্কার আর চুলাতে দাউদাউ করে তখন আগুন জ্বলছিল, লালচে আগুনের শিখা উন্মত্তভাবে বেরিয়ে আসছিল। পেছনে না ফিরেই, ফারাহ আমাকে তার ব্যভিচার, সম্ভ্রম আর আত্মহত্যা সম্পর্কে কিছু একটা বলে। আমি তার কথা শুনে খুবই অস্বস্তি হতে থাকে, কিন্তু আমার ধমনীর ভেতরকার রক্ত ততক্ষণে গরম হয়ে ওঠে আর আমি হালিমার কাছ থেকে আমার রাইফেলটা চেয়ে নিয়ে, সেটা ফারাহ’র দিকে তাক করে, ট্রিগার চাপি। ওর দিকে আমি একটা গুলি ছুড়ি, শিকারি রাইফেলের সেই একটা গুলিই মৃতের পাশে পাওয়া যায়। আমি যা করেছি তা আমার পরিবারের ভালর জন্যই করেছি, আমার পরিবারের মান সম্মান রক্ষা করেছি। আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাই, স্যার, যাতে আপনারা আমার অবস্থান থেকে একটু বিবেচনা করে দেখেন, আর আমার বিশাল পরিবারের অবস্থার কথা যদি একটু ভেবে দেখতেন। আর একথাও সত্য এই দরিদ্র অবস্থা থেকে আমি নিজের চেষ্টায় লেখা পড়া শিখেছি। আমি একজন অবসর প্রাপ্ত কর্পোরাল। আমি সেই কলঙ্কিনী নারীকে হত্যা করেছি, ইওর অনার, কেননা সে ব্যভিচার করেছে, সে আমার সামনা সামনি, তার সেই পাপের কথা আপনা থেকে স্বীকারও করে গেছে। লাল জামা পড়ে সে জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে, বলেছে যে সে পাপ করেছে, সে বলেছে সে তার পরিবারের সম্মানে কালিমা লেপে দিয়েছে।
কী ? অপর প্রত্যক্ষদর্শী, নুরিয়ার কথা বলছেন ? আপনি কি মনে করেন সাক্ষী, নুরিয়া যা বলেছে তা সত্য, সারা রাত কি সে সেই একই ঘরে ছিল ? এই সাক্ষ্যের কোন দাম নেই, ইওর অনার। সে একটা পাগল। কেন, তাহলে মৃতা নিজেই আমার কাছে আপনা থেকে সব স্বীকার করতে গেল যে সে ব্যভিচার করেছে। আমার বোন, হালিমাও, ফারাহকে নিজ চোখে সেই লজ্জাজনক অবস্থায় দেখেছে যেটা মোটেই সম্মান জনক নয় আর আইনও তা ক্ষমা করতে পারে না।
যে যুবতী মেয়ে লোক তার স্বামীর জেলে থাকার সুযোগ নিয়ে নিজের প্রেমিককে মিলিত হতে ডাকে, যে যুবতী নারী তার স্বামীর বিছানায় সূর্য ডোবার পর নিকৃষ্টতম অপরাধ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তার সম্পর্কে আর সবার কী বলার আছে। হ্যাঁ, সম্মানিত জুড়িগণ, যখন পরিবারের সবাই তার স্বামী ‘আব্দ আল-হামজার গ্রেপ্তার নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিল, তখন বার বউ কী করছিল ? সে তখন সেই অপরাধী, তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের আয়োজনে ব্যস্ত ছিল।
স্যার, আমি খুব একটা শিক্ষিত নই। আপনাদের অনেকেই হয়তো আমাকে সাদাসিধা সাধারণ বলে ভাবছেন, কিন্তু আমাদের সমাজে আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি, স্যার, যদিও এখনও আমার বয়েস ত্রিশ পেরোয়নি। আমি মৃতের কাছে খুবই স্পষ্ট করে বলেছি যে আমাদের বাড়িতে ব্যভিচারের মতো কোন অপরাধ করা যাবে না। আমিদের পরিবারটা খুবই সম্ভ্রান্ত, রক্ষণশীল গোত্রের একটা পরিবার; এধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা আমরা আমাদের মান সম্মান মোটেই ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারি না। আমি ফারাহকে তার উদ্ভট চিন্তাভাবনা ত্যাগ করতে রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করেছি এবং এধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে কাউকে না জড়াতে বার বার নিষেধ করেছি। কিন্তু পাগলের মতো, সে সেই একই কাজ বার বার করতে থাকে। তাই আমি তাকে তার নিজের ঘরে যেতে দেই যাতে তার একটু জ্ঞান হয়। যা ঘটেছে হালিমাকে খুলে বলি। তারপর গোসলে যাই। যখন গুলির শব্দ শুনি তখনও আমার গোসল শেষ হয়নি। দৌড়ে আমি উঠানে আসি। চারদিকে ধোঁয়াটে ফর্সা আলো, ইওর অনার। চুলা থেকে সমানে দাউদাউ করে লালচে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে, আর আমার খালা নুরিয়া তখন সামনে এসে জানতে চাইছে কে গুলি ছুড়েছে। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে, দৌড়ে আমার ভাই ‘আব্দ আল-হামজার ঘরের দিকে যাই, যেখানে আমি ফারাহ আর তার প্রেমিক কে এক সঙ্গে দেখতে পাই। তখন সে মরে পড়ে ছিল; সম্ভবত সে আত্মহত্যা করেছে। আমি বন্দুকটা নিয়ে হালিমাকে সঙ্গে করে ওর ঘরে ফিরে আসি।
কিন্তু এখন আমি আবারও সত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এধরনের আচরণের সঙ্গে আপনারা মোটেই পরিচিত নন, সম্মানিত স্যারেরা, সম্ভবত এধরনের অভ্যাস আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। আমরা দরিদ্র বেদুইন গোত্রের লোকেরা বেশীক্ষণ ধরে একটি বিষয়ের ওপর মনযোগী থাকতে অভ্যস্ত নই। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের মন একেবারেই অগোছালো। আমরা একটা বিষয় নিয়ে ভাবি কিন্তু সেই ভাবনা ফুরাবার আগেই, আরো বেশী আকর্ষণীয় অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে শুরু করি অথবা আমাদের মনের সব শেষ কামনার কথা বলতে শুরু করে দেই।
আমরা হয়তো খুবই সাদামাটা লোক, কিন্তু আমারা খুবই সম্মানিত, আমরা শান্তিতে আমাদের রুটি রুজি ভোগ করতে চাই, খেতে চাই। আমাদের সম্বন্ধে সে সব গুজব ছড়ানো হয় তার সবই মিথ্যা। আমার কথাই ধরুন, ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই নিরীহ একজন লোক, আগেও আমি আপনাদের কাছে সে কথা বলেছি। আপনারা জানেন যে নিজের সম্মান নিজেকেই রাখতে হয়, সম্মান সব সময় একই থাকে; এর কোন পরিবর্তন নেই। সম্মানের দিক থেকে সব মানুষই সমান। সম্মানের জন্য আমরা মরতেও প্রস্তুত এবং রক্তদিয়ে হলেও আমাদের সেই সম্মান রক্ষা করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই যা করে আমিও তার চাইতে বেশী কিছুই করিনি, অন্তত যখন আমার মতো বিবাহিত একজন লোক যার ওপর তার বিশাল পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সম্ভবত পরিস্থিতি অনেক জটিল বলে মনে হলেও সত্যি সত্যি সেটা অতটা জটিল নয়।
হ্যাঁ, ইয়োর অনার, আরক বার আমি আপনার সামনে সত্যটা ঘটনাটা বলতে চাই, শেষ বারের মতো বলতে চাই। আমরা একটা পরিবার একটাই ঘরে মিলেমিশে থাকি। আমার ভাই, ‘আব্দ আল-হামজা এবং তার বউ, খুন হওয়া ফারাহ, সেই বাড়ির একটা অংশে থাকে; আমার বাবা মা’র পাশে, তার পাশেই আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকি। আমার একটি বউ আর চারটা ছেলেমেয়ে আছে। আমাদের পাশেই থাকে আমার সৎ-বোন, হালিমা, কুয়ার কাছে তার নিজ ঘরে থাকে। চুলাটা উঠানের মাঝামাঝি অবস্থিত। এখন আসি, ঘটনার দিন আমারা আমার ভাইয়ের গ্রেপ্তার নিয়ে আলাপ করছিলাম। আমার কথা শুনে সে কৃষি সংস্কার আইন ভেঙ্গেছিল; পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। খালা নুরিয়া রাতটা তার বউ ফারাহ’র সঙ্গে থাকতে আসে। খুবই সরল ঘটনা। তখন সেই মৃতের প্রেমিক গোপনে বাড়িতে ঢুকে পড়ে, যা আমাদের তখন জানা ছিলো না। এবং মাঝরাত বা তারও খানিক বাদে, বার বার করে পরিবারটার সম্ভ্রম হানি হতে থাকে। সকাল পর্যন্ত সব কিছু চুপচাপই ছিলো, যে সময় স্বভাবতই সকালের নাস্তা তৈরি হয় এবং রুটি বানানো শুরু হয়। তখনই সেই ন্যক্কার জনক ঘটনার পুরোটা হঠাৎ-ই প্রকাশ হয়ে যায়।
এভাবেই ঘটনাটা ঘটেছে, ইয়োর অনার। মারা যাওয়া, ফারাহ, এই নারী যে কিনা সারা রাত ধরে নিজের ইচ্ছায় ব্যভিচার করেছে, সজাগ থেকে ! হ্যাঁ, কোন রকম ক্লান্তির ভান না করে আর ঘুমাতে না গিয়ে, সুর্যওঠার আগে সে জেগে ওঠে, যেন সে কিছুই করেনি, যেন সবে ঘুম থেকে উঠে অন্যদের জাগাতে এসেছে ! পাপ তার মনকে একটুও ধোঁকা দিতে পারেনি, সম্মানিত স্যারেরা। না, না, সেই আমাদের জাগিয়েছে। তার চোখ তখন জ্বল জ্বল করছিল, তার চুল ছিল আলুথালু, সে ঘোষণা করে আমাদের বাড়িতে ব্যভিচার হতে দেখার চাইতে তার আত্মহত্যা করাই ভালো ! যেন সে তখনও তেমন কিছুই করেনি, যেন কুৎসিৎ কদাকার সেই অপরাধ, সেই যৌন লালসার কিছুই তখনও ঘটেনি ! সেই সময়, হালিমা বলে ওঠে সে তাকে তার প্রেমিকের সঙ্গে নগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছে, হ্যাঁ, সারা রাত ধরে ব্যভিচার করেছে। ফারাহ কেঁপে ওঠে আর ওর মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায়, সত্যটা সরাসরি বলায় সে পিছিয়ে যায়। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
তারপর কী করে ? তার নিজের রক্তে সেই নারীর কলঙ্ক মুছে দেয়া ছাড়া আমার আর তখন কিছু করার থাকে না। মনে রাখবেন, সম্মানিত স্যারেরা, এভাবেই আমাদের সমাজে কলঙ্ক আর অমর্যাদাকে দূর করা হয়, নারীদেরই রক্তদিয়ে তা ধুয়েমুছে ফেলা হয়। আমি কাপর পড়ে শিকারের রাইফেলটা হাতে নেই, এবং তার কাছে যাই। আপনাদের কাছে যেমনটা বলেছি, তেমনি করে সে ছুলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ধবল ভোরের আকাশটা, আর নীচে চুলার ভেতর থেকে সমানে দাউদাউ করে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। আমরা দু’জন সেখানে একাই ছিলাম। সে আমাকে বলেছে ব্যভিচারের পাপের কোন শাস্তি হবে না সেটা সে সহ্য করতে পারবে না তাই সে আত্মহত্যা করছে। আমার সামনে তখন তাকে শিকারের রাইফেল দিয়ে গুলি করা ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিলো না। এরপর হালিমা এসে অনৈচ্ছিকভাবে জ্বলন্ত চুলাটাতে মুঠো ভর্তি কার্তুজ ছুড়ে মারে। সেই বিস্ফোরণ বাড়ির আর সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে।
এটাই হলো সত্য, সম্মানিত স্যারগণ, এটা পুরোপুরি সত্য। এর বাইরে যা যা শুনেছেন সব বানোয়াট।
নুরিয়া খালা যা যা বলেছে, সারা রাত ধরে সে ফারহ’র সঙ্গে ছিলো, কোন লোককে তিনি সে বাড়িতে ঢুকে ফারাহ’র সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখেননি এর সবই মিথ্যে। আপনারা যদি সেই মেয়ে লোকটার কথা বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে সেই নুরিয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাহলে কেন তিনি ভোরে ফারাহকে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেনি ? তাহলে ফারাহকে প্রথমে চুলা জ্বালাবার কথা কে বলেছিল ? এবং, যদি তার নাস্তা বানাবার উদ্দেশ্য ভালই হয়ে থাকতো তাহলে, কেন সে হালিমার ঘরে এসেছিল ?
হ্যাঁ, আমিও তার সেই মিথ্যে সাক্ষ্য শুনেছি। নুরিয়া দাবী করেন সে ফারাহকে মারা যেতে দেখেছেন, মৃত্যু তাকে শীতল করে করে দেবার আগে সে আমাদের দেখিয়ে …. আমার দিকে আঙ্গুল তুলে মরার আগে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। এসবের কোন কিছুই সত্য নয়, ইয়োর অনার ! কারণ আর কেউ নয়, আমিই ফারাকে সে যেখানে আত্মহত্যা করেছিল সেই চুলার কাছ থেকে টেনে নিয়ে তার ঘরে রেখে এসেছিলাম, তারপর আবারও তাকে আগের জায়গাতে এনে রাখি। কেবল আমি একাই জানি কোথায় ফারাহ পড়ে ছিল আর কোথায় সে মারা গেছে।
তদন্তকারীর রিপোর্টেও ভুল ছিল। সেই রিপোর্টে দাবী করা হয় একটা রিভলভারের গুলিতে মৃতের শরীরে মারাত্মক ভাবে জখমের সৃষ্টি হয়। যাই বলুন না কেন, আমি নিজেই ট্রিগার চেপেছিলাম, কেবল আমিই ভালো জানি আমার হাতে তখন কিধরণের অস্র ছিল।
পুরো ঘটনায় হালিমার ভূমিকা সম্বন্ধে কোর্টের সামনে যা কিছু বলা হয়েছে তার সবই মিথ্যা, একেবারে নির্জলা মিথ্যা। স্রষ্টার দোহাই দিয়ে, ইয়োর অনার, নিষ্পাপ এই মেয়েটাকে এর থেকে নিষ্কৃতি দেবার প্রার্থনা জানাচ্ছি। এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। আমিই মূল অপরাধী—যদি আপনি সেটা বলতে চান—যে তার মানসম্মান রক্ষা করতে ভণ্ড ফারাহ নামের কলঙ্কিনীকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে।
আমি পুরোপুরি নিষ্পাপ, সম্মানিত স্যারগণ। আমি যদি খুনের মতো অপরাধই করে থাকি, সেটা করেছি একটা মহান কারণে—আমার পরিবারের মানসম্মান সম্ভ্রম রক্ষার খাতিরে। আর এই কারণেই আমি আপনার সামনে আমাদের সম্মানিত বলে উল্লেখ করেছি, স্যার, তাই এই বিচারে আমার প্রতি দয়ালু ভাবে রায় দিন।
আমাকে বিশ্বাস করুন, এখানে এমন কেউ আছে যে আমার জন্য শোক করবে। হ্যাঁ, এখানেই আছে। এবং এটাই সত্য, ইয়োর অনার, একথা পুরোপুরি সত্য।
মে জয়েসি এবং এলিজাবেথ ফেরনিয়া এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে সোহরাব সুমন।
You must be logged in to post a comment Login