মাহবুবুর শাহরিয়ার

কবর

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

তাঁকে কবর দেয়া হলো বনানী কবরস্থানে৷

তাঁকে কোথায় কবর দেয়া যায় তাই নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম৷ আমরা যারা এই শহরে অভিবাসী, বহু বছর ধরে এ শহরে বসবাস করেও এ শহর আমাদের ঠিক আপন হয়ে ওঠেনি৷ দীর্ঘদিন এক জায়গায় বসবাস করলে শিকড় গজিয়ে যাওয়ার কথা৷ আমাদের শিকড় গজায়নি৷ আমরা শিকড় ছড়াতে চেয়েছি, কিন্তু এ শহরের শিকড় গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই৷ তাই নিজেদের আমাদের শিকড়হীন মনে হয়৷ আমরা যেনো সেই একাত্তরের উদ্বাস্তুর মতো, আমাদের শরীর রয়েছে এ শহরে, অথচ আমাদের মন পড়ে থাকে অনেক দূরে, স্মৃতির গভিরে তলিয়ে যাওয়া সেইসব ছোট ছোট মফস্বলগুলোতে৷ যেখানে আমরা বেড়ে উঠেছি, যে জায়গাগুলোর আলো হাওয়ায় আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে৷ সে কারণে আমরা বলি, রাজনৈতিক সীমানা মানুষের প্রকৃত দেশ নয়৷ যে জায়গায় সে বেড়ে ওঠে, তার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি যে জায়গাটার সাথে জড়িয়ে থাকে, চোখ বুজলে যে জায়গার স্মৃতি মনে করে তার হৃদয় দ্রবীভূত হয়, সেটাই তার প্রকৃত দেশ৷ এর বাইরে পৃথিবীটাকে টুকরো টুকরো করে দেশ নামক যে অদ্ভুত জিনিসটার ধারণা মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়, সে রাজনৈতিক আরোপন মাত্র৷ সে হিসেবে ধরতে গেলে এ শহর, এ ঢাকা আমাদের দেশ নয়৷ আমাদের দেশ ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের সেইসব জায়গাগুলোতে, আমাদের পিতার চাকুরীর সুবাদে যে জায়গাগুলোতে আমরা পার করেছি আমাদের শৈশব কৈশোরের রঙিন দিনগুলো৷ আর তাই, এতো বছরেও এ শহর আমাদের আপন হয়ে ওঠেনি৷ অথচ আশ্চর্য, আমাদের শৈশব কৈশোরের সেসব জায়গাগুলোতেও আমাদের আর ফিরে যাওয়ার নেই৷ সেখানেও আমরা এখন অবাঞ্চিত, অনাহুত৷ এখন আমাদের আর সেখানে কেউ চেনে না৷ তাই শরীর আর মন দু’জায়গায় রেখে আমরা উদ্বাস্তু হয়ে রয়ে যাই৷

তাই এ শহরের বুকে যখন তাঁর মৃত্যু হয়, আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি, কোথায় তাঁকে কবর দেয়া যায়৷ এ শহর আমাদের আপন নয়, অথচ আমাদের ফিরে যাওয়ারও কোথাও নেই৷ কাজেই কবর তাঁকে এখানেই দিতে হবে৷ কিন্তু কোথায়? এ শহরে কিছু কবরস্থান আছে বটে, কিন্তু সেগুলোতে কি জায়গা খালি আছে? এতো ভীড় এ শহরে, কবর দেয়ার জায়গা পাওয়া যাবে কি? যদি যায়ও তবে খরচ আমাদের সাধ্যে কুলাবে তো?

দীর্ঘ আলোচনার পর আমাদেরকে বনানী কবরস্থানে যেতে পরামর্শ দেয়া হয়৷ সেটা আমাদের বাসস্থানের কাছাকাছিও বটে৷ আমরা প্রথমে আতঙ্কিত হই, সেখানেও কি জায়গা পাওয়া যাবে? তবুও আমরা সেখানে যাই৷ গিয়ে আমরা আশ্চর্য হই৷ সেখানে জায়গা আছে, অনেক জায়গা৷ আমরা কবরস্থানটার দিকে তাকাই৷ কবরস্থানটা সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ কবরস্থান যেমন হওয়া উচিত, একটা শান্ত গাম্ভির্যের ভাব আছে সেখানে৷ পাথরে বাঁধাই করা কবরগুলো সারি সারি সজ্জিত৷ বাঁধাই করা কবরেই তো জায়গা শেষ হয়ে গেছে, তাহলে নতুন কবর কোথায় হবে?

জায়গা আছে৷ আমাদের বলা হয়৷ অতএব আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ করতে অফিস ঘরে ঢুকি৷ আমরা দ্বিতীয়বার আশ্চর্য হই, যখন দেখি হাজার পাঁচেক টাকায় সবকিছু হয়ে যায়৷ তখন আমরা কাগজপত্র পূরণ করে অফিসঘর থেকে বের হই৷

অফিস ঘরের পাশে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে কেউ৷ এ ব্যবস্থা ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা, কেননা উপরে লেখা রয়েছে- অনুগ্রহ করে ফারিয়ার জন্য দোয়া করুন৷

কে ফারিয়া? আমাদের জানা নেই৷ হয়তো ছোট্ট মেয়েটি ছিলো৷ বাবা মায়ের আদরের মেয়েটি অকালে শুয়ে আছে এখানে৷ পিতা মাতা এখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে করুণ আবেদন জানিয়েছে এ পানি পান করা ব্যক্তি যেনো সেই ছোট্ট মেয়েটির জন্য একটু দোয়া করে৷

আমরা বাঁধাই করা কবরগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাই৷ অনেকদূর যাবার পর বাঁধাই করা কবরগুলো শেষ হয়৷ এরপরেই অনেকখানি খোলা জায়গা৷ বেশ কিছুটা দূরে সীমানা প্রাচীর দেখা যায়৷ ওপাশে সীমানা প্রাচীরের ধার ঘেষে কিছু কবর৷ কবরগুলো এদিক থেকে শুরু হয়ে ওদিকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো৷ ওদিক থেকে শুরু হয়েছে কেনো? তখন আমাদের একটা আশ্চর্য গল্প বলা হয়৷

কবরস্থানের এই জায়গাটা, মানে যে নতুন ফাঁকা জায়গাটা আমরা দেখছি, সেটা একটা কোম্পানী অবৈধভাবে দখল করে ছিলো৷ রাজউক অনেকবার দখলদারী উচ্ছেদ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি৷ একবার রাজউকের চেয়ারম্যান দখল উচ্ছেদ করার মানসে এখানে এসেছে, গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই দখলকারী কোম্পানীর অন্তত শ’দুয়েক লোক তার দিকে তেড়ে গেছে৷ চেয়ারম্যান তখন নিজের প্রাণটা নিয়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠে পালিয়েছে৷ শেষে বিগত ফখরুদ্দিন সরকারের সময় সেনাবাহিনীর বুলডোজার দিয়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে কবরস্থানের জায়গা ফিরিয়ে দেয়া হয়৷ তখন নতুন কবরগুলো ওপাশের সীমানাপ্রাচীর থেকে শুরু করা হয়, যেনো জায়গাটা নতুন করে দখলের কবলে না পরে৷

আমরা কবরস্থানের ভিতরে ইতস্তত ঘুরে দেখতে থাকি৷ নতুন কবরস্থানে কবর বাঁধাই করার নিয়ম নেই৷ কিন্তু পুরাতনটায় সারি সারি বাঁধাই করা কবর৷ কতো স্মৃতি শুয়ে আছে এখানে৷ আমরা ঘুরে ঘুরে এপিটাফগুলো পড়তে থাকি৷ অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মৃত দু’জন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর কবর আমরা দেখি নিজেদের সীমাবদ্ধ জায়গা পেরিয়ে রাস্তার উপরে চলে এসেছে৷ কাণ্ড দেখে সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়, যে গল্পে এক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় গ্রামের মানুষকে বলে- আমি সারাজীবন তোমাদের জ্বালিয়েছি, আমি জানি আমার উপর তোমাদের অনেক রাগ৷ আমি মরে গেলে তোমরা এক কাজ করো, আমাকে বাঁশের সাথে লটকে গ্রামের সীমানায় টাঙিয়ে রেখো৷

তার মৃত্যুর পর গ্রামের মানুষ ঠিক তাই করে, লোকটার মৃতদেহ বাঁশের সাথে লটকে গ্রামের সীমানায় টাঙিয়ে রাখে৷ মনে মনে তারা শান্তি পায় এই ভেবে যে যে লোকটা বেঁচে থাকতে তাদের অনেক জ্বালিয়েছে, অন্তত মরণের পর তাকে শাস্তি দেয়া গেছে৷ কিন্তু হঠাত করে গ্রামে পুলিশ হানা দেয় এবং গ্রামশুদ্ধ মানুষকে ঐ লোকটার হত্যাকারী মনে করে ধরে নিয়ে যায়৷ মানুষগুলো তখন বলাবলি করে যে ব্যাটা বেঁচে থাকতেও জ্বালিয়েছে, মরে গিয়েও জ্বালালো৷

ইতিমধ্যে আমাদের কবর খোড়া হয়ে যায়৷ আমরা তখন তাঁর তেয়াত্তর বছরের পুরানো দেহটাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে দেই৷ কতো স্মৃতি শুয়ে আছে এই কবরস্থানে, আরেকটা নতুন স্মৃতি যুক্ত হয়৷

আমরা তখন সেই তেয়াত্তর বছরের স্মৃতিকে পিছনে রেখে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাই৷ একদিন আমরাও সব স্মৃতি হয়ে যাবো, আর কিছু নয়৷

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to কবর

You must be logged in to post a comment Login