কবর
তাঁকে কবর দেয়া হলো বনানী কবরস্থানে৷
তাঁকে কোথায় কবর দেয়া যায় তাই নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম৷ আমরা যারা এই শহরে অভিবাসী, বহু বছর ধরে এ শহরে বসবাস করেও এ শহর আমাদের ঠিক আপন হয়ে ওঠেনি৷ দীর্ঘদিন এক জায়গায় বসবাস করলে শিকড় গজিয়ে যাওয়ার কথা৷ আমাদের শিকড় গজায়নি৷ আমরা শিকড় ছড়াতে চেয়েছি, কিন্তু এ শহরের শিকড় গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই৷ তাই নিজেদের আমাদের শিকড়হীন মনে হয়৷ আমরা যেনো সেই একাত্তরের উদ্বাস্তুর মতো, আমাদের শরীর রয়েছে এ শহরে, অথচ আমাদের মন পড়ে থাকে অনেক দূরে, স্মৃতির গভিরে তলিয়ে যাওয়া সেইসব ছোট ছোট মফস্বলগুলোতে৷ যেখানে আমরা বেড়ে উঠেছি, যে জায়গাগুলোর আলো হাওয়ায় আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে৷ সে কারণে আমরা বলি, রাজনৈতিক সীমানা মানুষের প্রকৃত দেশ নয়৷ যে জায়গায় সে বেড়ে ওঠে, তার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি যে জায়গাটার সাথে জড়িয়ে থাকে, চোখ বুজলে যে জায়গার স্মৃতি মনে করে তার হৃদয় দ্রবীভূত হয়, সেটাই তার প্রকৃত দেশ৷ এর বাইরে পৃথিবীটাকে টুকরো টুকরো করে দেশ নামক যে অদ্ভুত জিনিসটার ধারণা মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়, সে রাজনৈতিক আরোপন মাত্র৷ সে হিসেবে ধরতে গেলে এ শহর, এ ঢাকা আমাদের দেশ নয়৷ আমাদের দেশ ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের সেইসব জায়গাগুলোতে, আমাদের পিতার চাকুরীর সুবাদে যে জায়গাগুলোতে আমরা পার করেছি আমাদের শৈশব কৈশোরের রঙিন দিনগুলো৷ আর তাই, এতো বছরেও এ শহর আমাদের আপন হয়ে ওঠেনি৷ অথচ আশ্চর্য, আমাদের শৈশব কৈশোরের সেসব জায়গাগুলোতেও আমাদের আর ফিরে যাওয়ার নেই৷ সেখানেও আমরা এখন অবাঞ্চিত, অনাহুত৷ এখন আমাদের আর সেখানে কেউ চেনে না৷ তাই শরীর আর মন দু’জায়গায় রেখে আমরা উদ্বাস্তু হয়ে রয়ে যাই৷
তাই এ শহরের বুকে যখন তাঁর মৃত্যু হয়, আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি, কোথায় তাঁকে কবর দেয়া যায়৷ এ শহর আমাদের আপন নয়, অথচ আমাদের ফিরে যাওয়ারও কোথাও নেই৷ কাজেই কবর তাঁকে এখানেই দিতে হবে৷ কিন্তু কোথায়? এ শহরে কিছু কবরস্থান আছে বটে, কিন্তু সেগুলোতে কি জায়গা খালি আছে? এতো ভীড় এ শহরে, কবর দেয়ার জায়গা পাওয়া যাবে কি? যদি যায়ও তবে খরচ আমাদের সাধ্যে কুলাবে তো?
দীর্ঘ আলোচনার পর আমাদেরকে বনানী কবরস্থানে যেতে পরামর্শ দেয়া হয়৷ সেটা আমাদের বাসস্থানের কাছাকাছিও বটে৷ আমরা প্রথমে আতঙ্কিত হই, সেখানেও কি জায়গা পাওয়া যাবে? তবুও আমরা সেখানে যাই৷ গিয়ে আমরা আশ্চর্য হই৷ সেখানে জায়গা আছে, অনেক জায়গা৷ আমরা কবরস্থানটার দিকে তাকাই৷ কবরস্থানটা সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ কবরস্থান যেমন হওয়া উচিত, একটা শান্ত গাম্ভির্যের ভাব আছে সেখানে৷ পাথরে বাঁধাই করা কবরগুলো সারি সারি সজ্জিত৷ বাঁধাই করা কবরেই তো জায়গা শেষ হয়ে গেছে, তাহলে নতুন কবর কোথায় হবে?
জায়গা আছে৷ আমাদের বলা হয়৷ অতএব আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ করতে অফিস ঘরে ঢুকি৷ আমরা দ্বিতীয়বার আশ্চর্য হই, যখন দেখি হাজার পাঁচেক টাকায় সবকিছু হয়ে যায়৷ তখন আমরা কাগজপত্র পূরণ করে অফিসঘর থেকে বের হই৷
অফিস ঘরের পাশে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে কেউ৷ এ ব্যবস্থা ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা, কেননা উপরে লেখা রয়েছে- অনুগ্রহ করে ফারিয়ার জন্য দোয়া করুন৷
কে ফারিয়া? আমাদের জানা নেই৷ হয়তো ছোট্ট মেয়েটি ছিলো৷ বাবা মায়ের আদরের মেয়েটি অকালে শুয়ে আছে এখানে৷ পিতা মাতা এখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে করুণ আবেদন জানিয়েছে এ পানি পান করা ব্যক্তি যেনো সেই ছোট্ট মেয়েটির জন্য একটু দোয়া করে৷
আমরা বাঁধাই করা কবরগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাই৷ অনেকদূর যাবার পর বাঁধাই করা কবরগুলো শেষ হয়৷ এরপরেই অনেকখানি খোলা জায়গা৷ বেশ কিছুটা দূরে সীমানা প্রাচীর দেখা যায়৷ ওপাশে সীমানা প্রাচীরের ধার ঘেষে কিছু কবর৷ কবরগুলো এদিক থেকে শুরু হয়ে ওদিকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো৷ ওদিক থেকে শুরু হয়েছে কেনো? তখন আমাদের একটা আশ্চর্য গল্প বলা হয়৷
কবরস্থানের এই জায়গাটা, মানে যে নতুন ফাঁকা জায়গাটা আমরা দেখছি, সেটা একটা কোম্পানী অবৈধভাবে দখল করে ছিলো৷ রাজউক অনেকবার দখলদারী উচ্ছেদ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি৷ একবার রাজউকের চেয়ারম্যান দখল উচ্ছেদ করার মানসে এখানে এসেছে, গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই দখলকারী কোম্পানীর অন্তত শ’দুয়েক লোক তার দিকে তেড়ে গেছে৷ চেয়ারম্যান তখন নিজের প্রাণটা নিয়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠে পালিয়েছে৷ শেষে বিগত ফখরুদ্দিন সরকারের সময় সেনাবাহিনীর বুলডোজার দিয়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে কবরস্থানের জায়গা ফিরিয়ে দেয়া হয়৷ তখন নতুন কবরগুলো ওপাশের সীমানাপ্রাচীর থেকে শুরু করা হয়, যেনো জায়গাটা নতুন করে দখলের কবলে না পরে৷
আমরা কবরস্থানের ভিতরে ইতস্তত ঘুরে দেখতে থাকি৷ নতুন কবরস্থানে কবর বাঁধাই করার নিয়ম নেই৷ কিন্তু পুরাতনটায় সারি সারি বাঁধাই করা কবর৷ কতো স্মৃতি শুয়ে আছে এখানে৷ আমরা ঘুরে ঘুরে এপিটাফগুলো পড়তে থাকি৷ অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মৃত দু’জন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর কবর আমরা দেখি নিজেদের সীমাবদ্ধ জায়গা পেরিয়ে রাস্তার উপরে চলে এসেছে৷ কাণ্ড দেখে সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়, যে গল্পে এক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় গ্রামের মানুষকে বলে- আমি সারাজীবন তোমাদের জ্বালিয়েছি, আমি জানি আমার উপর তোমাদের অনেক রাগ৷ আমি মরে গেলে তোমরা এক কাজ করো, আমাকে বাঁশের সাথে লটকে গ্রামের সীমানায় টাঙিয়ে রেখো৷
তার মৃত্যুর পর গ্রামের মানুষ ঠিক তাই করে, লোকটার মৃতদেহ বাঁশের সাথে লটকে গ্রামের সীমানায় টাঙিয়ে রাখে৷ মনে মনে তারা শান্তি পায় এই ভেবে যে যে লোকটা বেঁচে থাকতে তাদের অনেক জ্বালিয়েছে, অন্তত মরণের পর তাকে শাস্তি দেয়া গেছে৷ কিন্তু হঠাত করে গ্রামে পুলিশ হানা দেয় এবং গ্রামশুদ্ধ মানুষকে ঐ লোকটার হত্যাকারী মনে করে ধরে নিয়ে যায়৷ মানুষগুলো তখন বলাবলি করে যে ব্যাটা বেঁচে থাকতেও জ্বালিয়েছে, মরে গিয়েও জ্বালালো৷
ইতিমধ্যে আমাদের কবর খোড়া হয়ে যায়৷ আমরা তখন তাঁর তেয়াত্তর বছরের পুরানো দেহটাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে দেই৷ কতো স্মৃতি শুয়ে আছে এই কবরস্থানে, আরেকটা নতুন স্মৃতি যুক্ত হয়৷
আমরা তখন সেই তেয়াত্তর বছরের স্মৃতিকে পিছনে রেখে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাই৷ একদিন আমরাও সব স্মৃতি হয়ে যাবো, আর কিছু নয়৷
One Response to কবর
You must be logged in to post a comment Login