ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১৩)
তের
-মেয়েটি কি আপনার বোন?
-হুম। কেন?
-আপন বোন?
-আপন বোন না নিজের বোন।
রফিক হেসে উঠে। বলে,
-ছোটতে আমি আপন অর্থ বুঝতাম না, কেউ যদি বলত আপন বোন, আমি না বুঝে উত্তর দিতাম আপন বোন না নিজের বোন।
এ কথা বলেই সে আবার হাসতে থাকে। কিন্তু দীনানাথবাবু সেই হাসিতে যোগ দেয় না বরং আরো গম্ভীর হয়ে যায়।
-কি ব্যাপার দীনানাথদা? এত গম্ভীর কেন?
-নাহ কিছু না।
-কিছু না মানে? কি হল আপনার হঠাৎ?
-এমনি। আমি বলতে চাই না।
-কি বলতে চান না?
-আপনি শুনলে রাগ করবেন আমার উপর।
-অযথা রাগ করব কেন? বলেন, আমি শুনব।
-না থাক।
বিকেলের কিছু আগে রফিক যখন গুলশানে বৈশাখীকে দেখতে যাওয়ার জন্যে বের হচ্ছিল তখন দীনানাথ বাবু তার পিছু নিলেন। ওর সাথে বহুদিন দেখা হয় না রফিকের। সন্ধ্যার আগে আগে তার সাথে দেখা হওয়ার পর দুজনে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছিল।
-কি এমন ব্যাপার ঘটল বলেন তো?
-না দাদা থাক। আপনি মন খারাপ করবেন।
-একবার বলেন রাগ করব, আবার বলেন মন খারাপ করব, বাপ্যারটা খুলে বলেন তো। আমি এখন না বললেই বরং রাগ করব।
দীনানাথবাবু চুপ করে থাকেন। রফিক আবার বলে,
-বলেন দাদা।
-তাহলে কথা দিন, মন খারাপ করবেন না।
-আরে আগে বলবেন তো।
-না আগে কথা দিন।
-আচ্ছা যান, কথা দিলাম। এবার বলেন।
-আপনার বোনকে আমি ওপাড়ায় দেখেছি।
-মানে?
-হ্যাঁ, আমি মিনার বাসায় আপনার বোনকে দেখেছি।
-মিনা কে?
-আপনাকে বলেছিলাম মনে নেই?
-তার মানে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
-মানে আমি আপনার বোনকে…
-দাঁড়ান, আপনি নিজে বুঝতে পারছেন তো কি বলছেন আপনি।
-জ্বী ব্রাদার, খারাপ জায়গায় আনাগোনা আমার অনেকদিনের, আমি উনাকে অনেক আগে থেকে চিনি।
রফিক বুঝতে পারে না সে কি বলবে, মা-বাবা মারা যাওয়ার সময় কি সে এতটা শক পেয়েছিল? দীনানাথবাবু রফিকের হাত ধরে বলে,
-কষ্ট পেলেন?
রফিক উত্তর দেয় না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে হাঁটা শুরু করে। দীনানাথবাবু পিছন থেকে তাকে ধরে ফেলে। বলেন,
-প্লিজ দাদা, রাগ করবেন না। আমার অনুরোধ এখন বোনের কাছে যাবেন না।
-কেন?
-আগে মাথা ঠান্ডা করুন।
কিন্তু সে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-দাদা আমাকে যেতে দিন।
-আচ্ছা চলেন আগে কোথাও গিয়ে বসি।
-না, আমি এখনি গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করব। যদি আপনার কথা মিথ্যে হয় তবে……
-এইতো দাদা আপনি আমার উপর রেগে গেছেন।
-আপনি আমার বোনকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবেন আর আমি চুপ করে থাকব।
-হুম। এইজন্যেই আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম না। প্লিজ শান্ত হোন। চলুন সামনে সিঁড়ির উপর গিয়ে বসা যাক।
দুজনে নীরবে শপিংমলের সামনের সিঁড়ির উপর গিয়ে বসে। দীনানাথবাবু রফিককে এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আজ।
সকাল থেকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল বৈশাখী। আজ কাজে আসতে পেরেছে একদম ঠিক সময়ে। কিন্তু ফুরফুরে মেজাজ বেশিক্ষন রইল না। সকালে কাজ শুরু করতেই বেশ কাজের চাপ গেল। কিছু নতুন ব্রান্ডের মাল এসেছে, সেগুলো সাজিয়ে রেখে বেশ কিছু কাষ্টমারও সামলাতে হল তাকে। সকালের এই কাজের চাপ শেষ হতেই ভাইকে দেখতে পেয়েছিল সে। ভাইকে দেখে খুশিই হয়েছিল। তবে ভাইয়ের সাথের লোকটিকে দেখে আজানা এক ভয়ে শংকিত হয়ে উঠেছে সে। লোকটিকে তার চেনা চেনা লেগেছে, ঠিক মনে করে উঠতে পারছে না। লোকটি কি কোন এক রাতে……।আর ভাবতে পারে না সে, লোকটিকে ভাইয়ের খুব কাছের মনে হয়েছে আর এতেই ভয় তার। ভাইকে কিছু উলটা পালটা বলবে নাতো? ভাই কিছু জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে, সে সেটা জানে।
সকালবেলা ফুরফুরে মেজাজে থাকার অবশ্য আরেকটা কারন ছিল। অনেকদিন পর আজ সকালে নিয়াজকে তার কালো পাজেরোটা নিয়ে ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি, মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সে। বড়লোকের ছেলের হয়ত এবার খেয়ালী আগ্রহে ভাটা পড়েছে মনে হয়। যখন এলোমেলো এইসব ভাবছে ঠিক তখনই বিপনী বিতানের দরজাতে নিয়াজকে দেখা যায়।
-কেমন আছ?
সে কিছুটা চমকে উঠে, আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
-আপনি? এখানে?
-হ্যাঁ, আজ তোমার বাসার সামনে যেতে পারেনি। দাদার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম।
এই বলে তাকে কিছু ফুল এগিয়ে দেয়।
-একি করছেন? প্লিজ আপনি যান, আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। জনসম্মুখে আমি কোন তামাশা চাই না।
নিয়াজ আহত দৃষ্টি এনে বলল,
-প্লিজ এরকম কর না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি।
বৈশাখী কোন কথা বলে না। এলেমেলো পড়ে থাকা সেন্টের বোতলগুলো সাজাতে থাকে।
-কিছু বললে না যে…
-প্লিজ আপনি এখন যান, পরে কথা বলব।
-এখন কথা বলতে দোষ কি?
-এটা পার্ক না।
-ঠিক আছে, ফুলগুলো নাও।
-না।
-প্লিজ, তুমি ফুলগুলো নাও, আমি চলে যাচ্ছি।
-না, আমি ফুল নিতে পারব না।
-কেন?
-আমি অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে কিছু নিতে পারব না।
-আমি অপরিচিত?
-জ্বী, প্লিজ আপনি আসুন।
-আমি যাব না।
-আপনি আসুন, আপনার সাথে পরে কথা বলব আমি।
-না, তুমি ফুল নিবে নাকি বল?
-না।
-নিবে না?
-না।
এবার নিয়াজের মাথায় রাগ উঠে যায়, এক হাতে ফুলগুলো নিয়ে অন্য হাত দিয়ে বৈশাখীর হাত শক্ত করে ধরে একটু মুচড়িয়ে দেয়। বৈশাখী ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে।
-অ্যাঁ, ছেড়ে দেন আমাকে, প্লিজ, আমি আপনার পায়ে পড়ি।
-কিসের এত দেমাগ তোমার? আমি দিনের পর দিন তোমার পিছনে ঘুরছি আর তুমি কিনা……
নিয়াজ একটু থামে। রাগে তার হাত কাঁপতে থাকে।
-জান আমার এক ইশারায় কত মেয়ে বিছানায় যেতে রাজি? জান?
-প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন, চলে যান আপনি।
-না যাব না।
বৈশাখী হাল ছেড়ে দেয়। শুধু কাতর কণ্ঠে হাত ছেড়ে দিতে বলে। এসময় বিপনি বিতানের ম্যানেজার তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নিয়াজের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলেন,
-একি করছেন? মগের মুল্লুক পেয়েছেন? ওর হাত ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি।
নিয়াজ এবার হাতে ছেড়ে দেয়, হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বৈশাখীর সামনে।
-বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আমার সব কিছুতেই শুধু তুমি, তুমি, তুমি…।আমাকে ভালবাসা দাও। আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
বৈশাখীর বদলে ম্যানেজার উত্তর দিলেন,
-আরে কি করছেন কি? এটা কি সিনেমা পেয়েছেন? গার্ড এই গার্ড…
গেটের দুজন গার্ডই এগিয়ে আসে। নিয়াজের দুহাত দুজনে ধরে গেটের দিকে নিতে থাকে হঠাৎ তাকে নিশ্চল দেখায়, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বৈশাখীর দিকে। কিন্তু বৈশাখী চোখে চোখ রাখতে পারে না, চোখ নামিয়ে নেয়। গার্ডগুলো তাকে গেটের বাইরে নিয়ে যেতেই ম্যানেজারবাবু বৈশাখীর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
-কাল থেকে আর আপনার কাজে আসার দরকার নাই।
-কেন?
-আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন? এতকিছুর পর আবার জিজ্ঞেস করেন কেন?
-শুধু এইজন্যেই?
-হ্যাঁ, আমি কোন হাঙ্গামা চাই না। আমি বড়লোকের এইসব ছেলেকে চিনি। অনেক ঝামেলা করবে।
-আচ্ছা আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
-হ্যাঁ, আমি কোনরকম ঝামেলা চাই না, যাওয়ার সময় এই মাসের বেতন নিয়ে যাবেন।
-আচ্ছা।
ঠিক এসময় সে দরজা দিয়ে ভাইকে ঢুকতে দেখে, পিছনে সেই লোকটি, তার বুক ধ্বক করে উঠে।
One Response to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১৩)
You must be logged in to post a comment Login