বালিকা
“পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
আমাদের এই বালিকাও আজ ক’দিন তীব্র যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছ। নিজেও সে সেটা বুঝে কি? তবে কিছু একটা যে হয়েছে, বয়:সন্ধিজনিত অনুভূতির প্রগাড় অনুভবে বিদীর্ণ হবার চেয়েও বেশ তীব্র এই নতুন অনুভব। কেমন জ্বালা ধরায়, পোড়ায়। হৃদয় বলতে কিছু একটা যে শরীরের ভেতর ওর অজান্তে ওকে হৃদয়বতী করে তুলছে… একটু একটু… পলকে পলকে, এক গোপন শিহরণ নতুন চরের মত জেগে উঠা হৃদয়ের শুণ্য প্রকোষ্ঠে গেড়ে বসছে! যা ওকে দোলায়, ভীত করে, আবার কাছে টানার মত ভদ্রগোছের দূরত্ব ও রেখে যায়।
যেন এক নিষিদ্ধ লোবান!
স্কুল ফেরত বালিকা নির্জন মাঠ ঘেসে বাড়ি ফেরার পথে আজকাল বড্ড নীরব। সাথীদের পথচলতি টুকরো খুনসুটি আর কলরবও কেন জানি বালিকার মৌনতায় ফাটল ধরাতে পারেনা।
নিজের বাসায় ফিরতে প্রথম যে মোড়টি পড়ে, চা’র দোকানটিকে ঘিরে ইদানিং দুষ্টু ছেলেদের বড্ড আড্ডা। এরা নতুন সিগ্রেট ফুঁকতে শিখেছে। আর বালিকাদের স্কুল যাবার এবং ফিরে আসার সময়গুলিই ওদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়। ওরা নিজেরাও কি তা জানে?
দলটির সামনে এসে, পথ চলতি বালিকার গতি বুঝি একটু শ্লথ হয়! সে কি থামতে চায়.. এক পলক? এই উঠতি রোমিওদের ভিড়ে সে রয়েছে। এক পাশে বসা। সাধারণ একজন ‘সে’। বালিকার কাছে ইদানিং তাকে কেন জানি ‘অসাধারণ’ কিংবা এর থেকেও ভারী কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয়, যা অনুভূতির গভীর থেকে বালিকার নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।
সবার ভিতরে থেকেও সৌভাগ্যবান বালক, বালিকার শান্ত দীঘির অশান্ত জলরাশির মাঝে জ্বলে ওঠা এক পলকের স্পর্শ পায়। একটু দেখতে ইচ্ছে করে বালিকাকে! মনের সম্পুর্ণ জোর খাটিয়েও সে তাকাতে পারে না।
বালিকা কি একটু আহত হয়? চলার গতি কি তার একটু বেড়ে যায়? হবে হয়ত।
বালকের জীবনও আজ ক’দিন ধরে এমনই এলোমেলো। মায়ের পিছু ঘুরঘুর করা ছোট্ট বাবুটি এখন না থাকলেও, মাকে কেন্দ্র করেই চলে ওর জীবন। কতটুকুই বা? তবুও তো জীবন! হৃদয় আছে তো। বালকও কি হৃদয়বানে পরিণত হওয়া শুরু করল? এরকমই কিছু একটা হবে, বালক অজান্তে অনুভব করে মনের বাইরে থেকে? ভিতরে উকি দিয়েও যে দেখা যায়, সে তো আর তা জানে না।
তবে মায়ের মা মা ঘ্রাণ কে ছাপিয়েও এখন অন্য এক ঘ্রাণে আবিষ্ট এই বালকের মন। বালিকাকে ঘিরে সময়গুলো কাটে তার এখন। কত কি যে ভাবে! অনুভব করে… কিন্তু নিজের অনুভবগুলোকে প্রকাশ না করতে পারার যন্ত্রণায় থেকে থেকে নীল হয়। স্কুল পলাতক এক মেয়ে যেন বালিকা। ওর সামনে এলেই বালকের জগত কেমন নিরব হয়ে যায়। কিন্তু অন্তরে তার নিরন্তর এক ঝড় বয়েই চলে…
‘ পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে ‘
বালিকার সামনে নিজের আজকের ভীরু মনোভাব, বালকের পাগল মনকে আরো পাগলা করে দেয়। সবার মাঝে থেকেও সে নিরব চীৎকারে হৃদয়ের অধিপতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ এতো কষ্ট নিয়ে আমি হৃদয়বান হতে চাইনা। তোমার হৃদয় ফিরিয়ে নাও ‘।
হৃদয়ের অধিপতি ও ততোধিক নীরব থাকেন।
বালিকা বাসার সামনে। ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে চায়। কাউকে কি দেখা যায়? বালিকার ফেলে আসা পথে কি কারো থাকবার কথা? নিজের মাংসল হৃদয়ের বড্ড কাছে এক নীলখাম… বালিকার হৃদয়ের গোপন কিছু অনুভব রুদ্ধ দুয়ার খুলে, অক্ষরে রুপ নিয়ে বালক হৃদয়ের পরম আরাধ্য জায়গায় সযতনে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়! কিন্তু হৃদয়ের বহু গভীর থেকে কি এক জ্বালাময় অনুভবে জ্বলছে বালিকা। তাই হৃদয়ের বাহিরের মাংসল হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকা নীল খাম, বালিকাকে বাইরে থেকেও অস্থির করে।
ভালোবাসার অনুভবে ক্রমশ: পূর্ণ হতে চলা এক বালিকা, ভেতরে-বাহিরে ভাঙতে থাকে… প্রথম প্রেমের সর্বগ্রাসী আগুন জ্বলে… বালক হৃদয়কে সেই আগুনে অবগাহন করিয়ে, দুই হৃদয়ের কষ্টগুলো ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে, কাছে থেকে পরখ না করলেই যে নিজেকে সে গড়তে পারবেনা। নিজেকে পুণর্গঠন কি খুবই জরুরী?
তাই দুই হৃদয়ের অধিকারিনী বালিকা মুখ ফিরিয়ে সামনের পানে তাকায়। এক আদিগন্ত রহস্যকে ধারণ করে মুহুর্তে বালিকা যেন বড্ড রমণীয় হয়ে ওঠে! বালিকা কি অপেক্ষা করবে? বালিকারা কি অপেক্ষা করে?
প্রথম প্রেম আস্বাদনকারী আমাদের এই বালিকার কি জানা হয়ে গেছে, সে এক নারী। নদীরা কখন নারী হয়? কিংবা নারীরা নদী?
যখন নদী ও নারী ভালোবাসার কথা বলে, তখন কি?
** কোট করা লাইনগুলো কবিগুরু রবি ঠাকুরের।
You must be logged in to post a comment Login