রফিকুন নবী

১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝিতে স্কুলপড়ুয়া এক বালক হাতে পেল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত মাসিক রম্য-ম্যাগাজিন ‘ম্যাড’৷ ম্যাগাজিনের কার্টুনগুলি বালকের নজর কাড়ে৷ একই সময়ে কিছু ভারতীয় পত্রিকার চিত্রাঙ্কন দেখেও সে মুগ্ধ হয়৷ মাসিক ম্যাগাজিন আর পত্রিকা-এই দুই-এর মাধ্যমেই কার্টুনের সাথে প্রথম পরিচয় হয় তাঁর৷ সেগুলি সম্পর্কে জানার আগ্রহটা বেড়ে চলল দিনে দিনে৷ শুরু হল সেগুলি সংগ্রহ করা৷ নিতান্তই শখ মেটাতে সে ভর্তি হল ঢাকার আর্ট কলেজে৷ এবার শুরু নিজের আঁকা৷ শখ করে ছবি আঁকতে শুরু করা সেদিনের সেই বালকটিই আজকের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী৷ দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় জীবনের প্রথম কার্টুনটি আঁকেন তিনি৷ কার্টুনটি ছিল ভিক্ষুকদের উপরে৷ বিষয় দারিদ্র্য৷ লক্ষ্য ছিল ভিক্ষুকদের ব্যবহার করে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অবস্থানটা তুলে ধরা৷ জীবনের প্রথম আঁকা সে কার্টুনটি কোথাও প্রকাশিত না হলেও আগ্রহ কমেনি এতটুকু৷

কার্টুনের প্রতি আগ্রহটা আরও বেশি জোরাল হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, বিভিন্ন যুব সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের কার্টুন পোস্টার আঁকার আহ্বানে৷ তত্‍কালীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে পোস্টার আঁকার অনুরোধ করত তারা৷ তখন সদ্য পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেছেন রফিকুন নবী৷ ২১শে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশাল আকারের ব্যানারে কার্টুন আঁকেন৷ গণজমায়েতে ব্যবহৃত হত তাঁর আঁকা এইসব অসংখ্য কার্টুন ব্যানার৷ কিন্তু সরকারি চাকুরে হওয়ায় ঐসব কার্টুনে নিজের প্রকৃত নাম স্বাক্ষর করা ছিল অসম্ভব৷ আবার একেবারে আলাদা কোন নামও নিজের কাছেই কেমন অস্বস্তি লাগছিল৷ তাই সেই পোস্টারগুলিতে নিজের প্রকৃত নামটিকেই সংক্ষিপ্ত করে তিনি লিখলেন রনবী৷ এই রনবীই পরে তৈরি করেন সর্বাপেক্ষা বেশি আলোচিত ও জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র টোকাই৷ রনবী পৌঁছে যান সব মানুষের হৃদয়ের কাছে৷

চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী অথবা কার্টুনিস্ট রনবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলায়৷ রফিকুন নবীর মাতুল ও পৈতৃক দুই পরিবারই ছিল সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ গোবরাতলা মহানন্দার তীর ঘেঁষে যে গ্রামটি, সেটিই ছিল তাঁর মাতুলালয়৷ পৈত্রিক ভিটে ছত্রাজিতপুর, শিবগঞ্জ উপজেলায়৷ মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন ছোটখাট জমিদার পরিবারের সন্তান৷ পিতা রশীদুন নবী ও পিতামহ মহিউদ্দীন আহমেদ দু’জনই ছিলেন পুলিশ অফিসার৷ রফিকুন নবীর পিতা রশীদুন নবীর ইচ্ছে ছিল শিল্পী হবেন৷ তত্‍কালীন কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়ার জন্য রশীদুন নবী তাঁর পিতা মহিউদ্দিন আহমেদের অনুমতি প্রার্থনা করলেন৷ কিন্তু পিতা মহিউদ্দীনের অনুমতি মেলেনি৷ রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কাছে যান রশীদুন নবী৷ তাঁর কাছে শেখার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিতার মত পুলিশের পেশাক গ্রহণ করলেও শিল্পী হওয়ার আগ্রহটা কখনও হারাননি৷ শখ করে ছবি আঁকতেন তিনি৷ কথাবার্তা, আচার-আচরণে তাঁর অন্তরলোকের শিল্পীকেই খুঁজে পাওয়া যেত৷ নিজের অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ত করতে ছেলে রফিকুন নবীকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আর্ট কলেজে৷ আর অবসরকালীন জীবনে মাটি দিয়ে অনেক প্রতিকৃতিমূলক মডেলিং করেছেন৷

পুলিশ অফিসার বাবার বদলির চাকুরির সুবাদে রফিকুন নবীর বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়৷ তাই দেশের বিভিন্ন এলাকা দেখার সুযোগটা তিনি পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই৷ পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় থিতু হন বাবা৷ পুরান ঢাকাতেই কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কাটে রফিকুন নবীর৷ ১৯৫০-এর মাঝামাঝিতে স্কুলে ভর্তি হন তিনি৷ পুরান ঢাকার পোগোজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন৷ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৫৯ সালে সম্পূর্ণ পিতার ইচ্ছায় ঢাকার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি৷ এখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং পরে আরও কতিপয় খ্যাতিমান দিকপালের সান্নিধ্যে থেকে পড়াশোনা করেন৷ আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে থাকতে নিজের আঁকা ছবি প্রথম বিক্রি করেন ১৫ টাকায়৷ স্থানীয় সংবাদপত্রে রেখাচিত্র এঁকে এবং বুক কভার ইলাস্ট্রেশন করে পরিচিতি লাভ করেন দ্বিতীয় বর্ষেই৷ ১৯৬২ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তি লাভ করেন তিনি৷ ‘৬৪ সালে স্নাতক পাশ করেন৷ ফল প্রকাশের পরের দিনই প্রথিতযশা শিল্পী ও শিক্ষক অধ্যাপক জয়নুল আবেদিন ছাত্র রফিকুন নবীকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালেন৷ একান্তে ডেকে নিয়ে আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে বলেন তাঁকে৷ রফিকুন নবী সে সময়ে ঢাকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত কাজ করতেন৷ নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কবি আবদুল গনি হাজারির কলাম কাল পেঁচার ডায়েরীতে৷ সব মিলিয়ে মাসিক বেতন ২৭৫ টাকা৷ আর আর্ট কলেজের শিক্ষকের বেতন তখন ছিল ১০ টাকার একটি বাত্‍সরিক ইনক্রিমেন্টসহ মাসিক ১৮০ টাকা৷ জয়নুল আবেদিন তাঁর ছাত্রকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, প্রতিষ্ঠান বড় হলে বেতন বাড়বে৷ পরের দিন আবার তাঁর বাবা রশীদুন নবীকে ডেকেও একই অনুরোধ করলেন জয়নুল আবেদিন৷ পিতা জানালেন জয়নুল আবেদিনের মত একজন সম্মানীয় ব্যক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের চিন্তা করাও উচিত্‍ হবে না৷ তবে ছাত্রদের সামাল দেওয়ার বিষয়টি ভেবে কিছুটা ঘাবড়েও গিয়েছিলেন রফিকুন নবী৷ নিজেকে কখনও শিক্ষক হিসেবে চিন্তাও করেননি৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেন তিনি৷ আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নিয়ে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়৷

১৯৭১ সাল৷ শুরু হলো যুদ্ধ৷ রফিকুন নবী প্রথমে ভাবলেন যুদ্ধে যাবেন৷ কিন্তু গেরিলা বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন, শহরে কয়েকজনের থাকা প্রয়োজন৷ তাই যুদ্ধে না গিয়ে তিনি রয়ে গেলেন ঢাকায়৷ ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কাপড় ও খাদ্য সংগ্রহ করা শুরু করলেন৷ পুরান ঢাকার নারিন্দায় তাঁর বাসাটিতে চলত গোপন মিটিংগুলি৷ বাংলাদেশ জন্মের পর নবী আবার মনোনিবেশ করেন শিক্ষকতায়৷ একইসাথে আঁকার জগতে৷ বছরখানেক পরে শিক্ষকদের জন্য একটি বৃত্তি এলো গ্রীসে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার৷ সকলেই ধরে নিয়েছিলেন বৃত্তিটা এসেছে রফিকুন নবীর জন্যই৷ যদিও তিনি আবেদনও করেননি৷ ততোদিনে ১৯৭২-এ সংসার শুরু করেছেন তিনি৷ সদ্য পিতা হয়েছেন৷ কিছুতেই চাচ্ছিলেন না বৃত্তিটা গ্রহণ করতে৷ তবুও পরিবার এবং সহকর্মীদের পরামর্শে রফিকুন নবী পাড়ি জমালেন গ্রীসে৷ ১৯৭৩ সালে গ্রীক সরকারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হলেন গ্রীসের এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্ট-এ৷ পড়াশোনা করলেন প্রিন্ট মেকিং-এর ওপর৷ গ্রীসের মানুষ তখন সাইপ্রাসের দখল নিতে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ তিন বছর কাটল হোমার, সক্রেটিস ও সফোক্লিসের দেশ গ্রীসে৷ ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি৷ শিক্ষক থেকে ধীরে ধীরে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত হন৷ পরে চারুকলা ইন্সটিটিউটের পরিচালক হন৷ ২০০৮ সালে নিযুক্ত হন নবগঠিত চারুকলা অনুষদের ডীন৷

১৯৬৯ সালের গনআন্দোলনে মুখর রাজপথ৷ তত্‍কালীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মিছিলগুলির প্রথম সারিতে থাকত পথের শিশুরা৷ পরিচয়হীন, অতি দরিদ্র আট-দশ বছরের এই পথ-শিশুরা হরতালে গাড়ির চাকার হাওয়া ছাড়ত, ২১শে ফেব্রুয়ারি এলে ইংরেজি-আরবিতে লেখা সাইনবোর্ড ভাঙত৷ তাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন রফিকুন নবী৷ একই সময়ে তাঁর বাসার পাশেই দেখেন আরেকটি শিশু৷ রনবীর ভাষায়, “আট-ন বছরের একটা ছেলে বসে থাকত৷ আমার বাসার ঠিক উল্টোদিকের টিনের বাসাটার এক চিলতে বারান্দায় মনের সুখে গড়াগড়ি দিত সারাদিন৷ পরনে চেক লুঙ্গি৷ মোটা পেটটায় কষে বাঁধা৷ মাথায় ছোট করে ছাঁটা খাড়া খাড়া চুল৷ ওর মা বিভিন্ন বাসায় কাজ করত৷ … টিনের বাড়ির বারান্দাটার পাশেই রাস্তার ধারে কাক আর কুকুরের খাদ্য সম্ভারে ভরা ট্যাপ খাওয়া টিনের একটা ডাস্টবিন ছিল৷ মাঝে মাঝে ডাস্টবিন ঘেঁটে কিছু কাগজপত্র, ভাঙা কাঁচ বা লোহা লক্কড় খুঁজে পেলে জমা করে রাখত বারান্দার কোণে৷” পাড়ার লোকদের তামাশার প্রশ্নগুলিতে নির্ভেজাল, বুদ্ধিদীপ্ত ও মজার উত্তর দিত সে৷ তখনই রফিকুন নবী প্রথম ভাবেন টোকাইয়ের কথা৷ মোক্কা নামের ঐ শিশুটিকেই তাঁর কল্পনার টোকাইয়ের মডেল করেন৷ একদিন হঠাত্‍ করেই হারিয়ে গেল সেই ছেলেটি৷ কিন্তু তার মুখের একটা ছাপ পড়ে ছিল রনবীর মনে৷ ঐ মুখটাকেই খুঁজতেন অকারণে৷ ‘৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞের পর ২৭ মার্চ কার্ফু্ উঠলে রনবী দেখেন গুলিস্তানের উল্টোদিকের দেয়ালের অপর পারে টাল দিয়ে রাখা অসংখ্য লাশ৷ পাশের রেললাইনের বস্তিবাসীদের লাশ৷ কিন্তু তাদের মধ্যে শিশুরাই যে বেশি! দু’বছর আগের সেই ছেলেটি আবার উঁকি দিল মনের কোণে৷ এরপর ‘৭৬-এ বিদেশ থেকে ফিরে আবাস গেড়েছেন নতুন পাড়ায়৷ একদিন বিকেলে বাসার সামনের মাঠে ছেঁড়া একটা বস্তা ঘাড়ে আট-ন’ বছরের একটা ছেলের দেখা মিলল৷ চমকে ওঠেন রনবী! যেন ৭ বছর আগের সেই পেটমোটা ছেলেটিই আবার ফিরে এসেছে৷ সেদিনই ওকে কিছু আস্কারা দিলেন তিনি৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই আসা-যাওয়া করতে লাগল সে৷ তাকে দেখলেই যেচে কথা বলতেন রনবী৷ আর নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে মজার মজার কথা বলত ছেলেটি৷ তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো ‘৬৯এর সেই ভাবনার৷ এবার নাম ঠিক করার পালা৷ এমন একটি নাম যা সামগ্রিকভাবে সব পথশিশুকেই নির্দেশ করবে৷ মোক্কা, টোকা মিয়া, এরপর টোকন, টোকাইন্যা৷ কিন্তু সবগুলি নামই কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয় রনবীর কাছে৷ অবশেষে টোকাই৷ প্রথম ভাবনার দীর্ঘ ৮ বছর পর রনবীর আঁকার জগতে জন্ম নিল নতুন এক অধ্যায়- টোকাই৷ ‘৭৮এ শুরু করা কার্টুনে রনবী টোকাইয়ের বয়স রেখেছেন আট৷ শিল্পীর কল্পনায় ‘৭১-এ বেঁচে যাওয়া পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন পথের শিশুই টোকাই৷

টোকাই শিরোনামে প্রথম স্ট্রিপ কার্টুনটি ছাপা হয় বিচিত্রার প্রারম্ভিক সংখ্যায় ১৯৭৮ সালের ১৭ মে৷ প্রথম কার্টুনে টোকাই একজন বড় কর্মকর্তা৷ বসে আছে তার বানানো অফিসে৷ রাস্তার ইট দিয়ে তৈরি একটি টেবিলে৷ প্রথম কার্টুনেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল টোকাই৷ নিয়মিত বিচিত্রায় ছাপা হল টোকাই৷ বিচিত্রা বন্ধ হলে ২০০০ সাল থেকে সাপ্তাহিক ২০০০-এ আবার শুরু করেন টোকাই৷ বছর চারেক পরে নিয়মিত টোকাই আঁকায় যতি টানেন রনবী৷ রনবীর আঁকা টোকাইয়ের মাথায় টাক, কখনও গুটিকতেক চুল, খাটো চেক লুঙ্গি মোটা পেটে বাঁধা৷ কখনো কাঁধে বস্তা৷ ‘৭৮-‘৭৯-এ ভোটের সময় বিলি করা জামা পরেছিল টোকাই, সেই জামাটি ছিল ওর থেকে অনেক বড় আকারের৷ টোকাই থাকে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে, ফেলে রাখা কংক্রিটের পাইপের ভেতর, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, কাঠের গুঁড়িতে, ঠেলা গাড়ির ওপরে, ইটের ওপর মাথা পেতে৷ তার পাশে থাকে কুকুর, কাক৷ টোকাই কথা বলে কাক, গরু, ছাগল, মশার সাথে৷ কথা বলে মানুষের সাথেও৷ তার কথা বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণতায় ভরা, আবার রসে সিক্ত৷ পেন অ্যান্ড ইঙ্কের পরে রনবীর টোকাই হাজির হল জলরঙের উচ্ছলতায়৷ সেখানে সে কখনও মনের আনন্দে মার্বেল গুটি দিয়ে খেলে, নৌকা চালায়, বাঁশি বাজায়, বেহালা বাজায়, কখনও রাস্তার বুকে উবু হয়ে লিখতে শুরু করে, কখনও আনন্দে দেয় ছুট৷ কখনও একা বসে থাকে, আবার কখনও পাঁচিলের উপরে উঠে পাশের দেয়ালের অপর দিকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, রাজকীয় বাড়ির দরজায় হাজির হয় কাঁধে বস্তা নিয়ে৷ রনবীর টোকাই এভাবে সমাজ-সংসারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলে প্রতিনিয়ত৷

এথেন্সে পড়াশোনা করার দ্বিতীয় বছরের মাথায় বই ইলাস্ট্রেশনের কাজ করে পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করেন রফিকুন নবী৷ সেই অর্থ দিয়ে ভ্রমণ করেন ইউরোপের অনেক দেশ৷ রোম, ফ্লোরেন্স, প্যারিস, লণ্ডন, কায়রো গিয়ে বিখ্যাত শিল্পীদের প্রকৃত কাজগুলি নিজের চোখে দেখেন৷ দেশেও চষে বেড়িয়েছেন এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে৷ নিসর্গকে প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে৷ দেশ বিদেশের এইসব অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে মনোনিবেশ করেন ছবি আঁকার জগতে৷ ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বিষয়-বৈচিত্র্যের এক দীর্ঘ পথে বিচরণ করেছেন শিল্পী৷ অনেকদিন মজেছিলেন ছাপাই ছবির জগত নিয়ে৷ কাঠের বুক চিরে ভেতরের মনোহর টেঙ্চারে আঁচড় কাটলেন, কাঠে সৃষ্টি করলেন কবিতার ব্যঞ্জনা৷ ছাপাই ছবির জগত ছেড়ে দীর্ঘ একযুগ পরে নতুন সৃষ্টির মানসে বাসা বাঁধলেন অন্য জগতে৷ ঋতুর বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির অস্পৃশ্য সৌন্দর্যকে পটে ধরবার জন্য নিসর্গের মায়ায় হারালেন শিল্পী রফিকুন নবী৷ হাতে নিলেন জলরঙের তুলি৷ শুকনো আবহাওয়ায় আউট ডোরে রঙের ওয়াশ দিলে সাথে সাথে শুকিয়ে যায়৷ সেখানে তিনি রচনা করেন নিজস্ব স্টাইল৷ আবার ভেজা আবহাওয়ায় দাঁড় করান আরেক আলাদা আমেজ৷ রঙের সঠিক পরিমাণ ব্যবহারে ছবিতে ফ্রেশনেস বজায় রাখা তাঁর আরেক বৈশিষ্ট্য৷ জলরঙে তাঁর অন্ধকারের চিত্রায়ণও একই কথা জানান দেয়৷ বিষয় বাছাই, রং ব্যবহার, আলোর বিন্যাস, একটা বিশেষ আলোকে বিশেষ স্থানে ব্যবহার ইত্যাদির সমন্বয়ে তিনি ছবিতে জন্ম দেন নাটকীয়তার৷ জলরঙকেই সবচেয়ে ভাল মাধ্যম মনে করেন শিল্পী৷ ছাত্র জীবনে শুধু সমুদ্র নিয়ে বহু কাজ করেছেন জলরঙে৷ সকালের সমুদ্র, দুপুরের সমুদ্র, বিকেলের সমুদ্র – সবই আলাদা রং নিয়ে ধরা দিয়েছে শিল্পীর চোখে, আর তাঁর আঁকা ছবিতে৷ কাজ করেছেন কক্সবাজার, টেকনাফের সমুদ্রে, ঢাকায়, রাজশাহীতে, চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের সাঁওতাল এলাকায়৷ বুড়িগঙ্গার ওপারে, জুরাইন এলাকায় বেশির ভাগ ছবি এঁকেছেন৷ ড্রাই কাজ করেছেন পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের চরে৷ এঁকেছেন পদ্মার সাদা চর, তারই পাশে পানি চক চক করছে, তারমধ্যে কালো কালো নৌকা, হঠাত্‍ কোথাও মাঝির লাল গামছাটা ওড়ানো; আবার এঁকেছেন বালু ওড়ানো এক ধরনের ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব৷ জলরং ছাড়াও অন্য সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন রফিকুন নবী৷ প্রকৃতি, মানুষের পাশাপাশি এঁকেছেন পশু-পাখি৷ এঁকেছেন উত্‍ক্ষিপ্ত ডানার পাখি, পাতার আড়ালের নিশ্চুপ পাখি, মোরগ, মোষ, হৃষ্ট ষাঁড়, একতারা হাতে ব্যাকুল বাউল, বানরওয়ালা, শিলাইদহের নদীতীরে অভিভূত রবীন্দ্রনাথ৷ সবখানেই রেখেছেন দক্ষতার স্বাক্ষর৷ দক্ষতা দেখিয়েছেন লেখার জগতেও৷ লেখালেখির শুরু সেই স্কুলজীবন থেকেই৷ তাঁর প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয় ‘৫৭-‘৫৮ সালের মাঝামাঝিতে ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে৷ পত্রিকায় কলাম লিখতেন নিয়মিত, এখনো লেখেন মাঝে মাঝে৷ শিশুদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে৷ পরে লিখেছেন আরো ৫টি৷ বছর দুয়েক সাপ্তাহিক বিচিত্রায় টিভি রিভিউ লিখতেন অর্থাভাবে৷

কলেজ জীবন থেকেই রফিকুন নবীর আঁকা ছবি স্থান করে নেয় বিভিন্ন প্রদর্শনীতে৷ ১৯৬০ থেকে ‘৬৪ পর্যন্ত ঢাকার কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট-এর বার্ষিক প্রদর্শনীতে, ‘৭৬-এ এথেন্সে৷ টোকাইয়ের ২৫ বছর পূর্তিতে গ্যালারী চিত্রকে একক প্রদর্শনী হয় ২০০৪ সালে৷ ২০০০-এ চারুকলা ইন্সটিটিউটের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অংশগ্রহণ করেন জয়নুল গ্যালারির যৌথ প্রদর্শনীতে৷ দেশের বাইরে ভারত, গ্রীস, যুগোস্লাভিয়া, জার্মানি, মালয়েশিয়া, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, রুমানিয়া, ইরান, চীন, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েনা, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়৷ এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত সব জাতীয় প্রদর্শনী ও সব দ্বিবার্ষিক এশিয়ান প্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন৷ দেশের জাতীয় আর্ট গ্যালারী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গভবন, সংসদ ভবন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংগ্রহশালা ইত্যাদি স্থানে তাঁর চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে৷ এছাড়া জর্ডানের রয়্যাল মিউজিয়ামে, গ্রীসের এথেন্সে, যুগোস্লাভিয়া এবং জাপানেও রয়েছে তাঁর চিত্রকর্মের সংগ্রহ৷

‘৯০ এর দশকে সেই সময়ের বাংলাদেশের সামরিক রাষ্ট্রপতি রনবীর টোকাইদের নিয়ে কয়েকটি স্কুল চালু করেন৷ স্কুলের নাম দেন পথকলির৷ টোকাই শব্দটিতে অবজ্ঞার প্রকাশ আবিষ্কার করে রাষ্ট্রপতি ১৯৯০ সালে রনবীকে টোকাই নামের পরিবর্তে পথকলি ব্যবহারের কথা ভেবে দেখতে বলেন৷ রনবী সেদিন কোন উত্তর দেননি৷ কিন্তু সামরিক জান্তার এই কথা শুনে জনগন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল৷ এরপর টোকাই বাংলা অভিধানে স্থান করে নিয়েছে নতুন শব্দ হিসেবে৷ অধুনালুপ্ত ‘বিচিত্রা’য় টোকাই একবার ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়৷ ১৯৯৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত শিশুশ্রম বিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে অন্যতম বিচারক হিসাবে অংশগ্রহণ করেন রনবী৷

রফিকুন নবী লাভ করেন একুশে পদক, চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, বুক-কভার ডিজাইনের জন্য ১৩ বার ন্যাশনাল একাডেমি পুরস্কার৷ ২০০৮-এর ৯ আগস্ট চীনের বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় অলিম্পিক চারুকলা প্রদর্শনীর৷ এখানে রফিকুন নবী একই বছরে আঁকা তাঁর খরা শীর্ষক ছবির জন্য ৮০টি দেশের ৩০০ জন চিত্রশিল্পীর একজন হিসাবে ‘এক্সিলেন্ট আর্টিস্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ মনোনীত হন৷

গম্ভীর চেহারার রফিকুন নবীর মাঝে সৃষ্টিশীলতার সাথে খেলে যায় রসবোধ৷ নিসর্গের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রং-তুলি হাতে তার প্রেমে নিজেকে হারাতে ভালবাসেন শিল্পী৷ আবার সমাজ ও রাজনীতি সচেতন রনবী ভাবেন সাধারণ মানুষের কথা, পথ-শিশুদের দুঃখ-দুর্দশাকে দেখেন বড় করে৷ কোন নিপীড়ন সহ্য করবেন না-এই তাঁর প্রতিজ্ঞা৷ শিল্পীর শিল্প-পরিমণ্ডল জুড়ে তাই স্থান করে নিয়েছে বাস্তব আর কল্পনার সম্মিলন৷ এক সত্তা যখন সুন্দরের পূজা করতে ব্যস্ত, অন্য সত্তা তখন সমাজ-বাস্তবতার অসঙ্গতিগুলোকে বিদ্রুপ করে কঠোরভাবে৷ শত ব্যস্ততার জীবনে আঁকার জগতটিই শিল্পীর সবচেয়ে বেশি প্রিয়৷ নিসর্গ-প্রেম আর টোকাই – এই দুই জগতকে নিয়েই রফিকুন নবী লালন করে চলেছেন সময়ের পথে তাঁর সাহসী যাত্রা৷

জীবনী সংক্ষেপ

পূর্ণনাম: মোঃ রফিকুন নবী
জন্ম: ২৮ নভেম্বর, ১৯৪৩
জন্মস্থান: চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ
পৈতৃক নিবাস: ছত্রাজিতপুর, শিবগঞ্জ
বাবা: রশীদুন নবী
মা: আনোয়ারা বেগম
স্ত্রী: নাজমা বেগম
পুত্র-কন্যা: দুই ছেলে, এক মেয়ে, এক নাতি এবং এক নাতনি৷

পেশা: শিক্ষক, কার্টুনিস্ট, পেইন্টার, খ্যাতনামা ইলাস্ট্রেটর, প্রচ্ছদ ডিজাইনার৷

প্রকাশনা: ৩ টি উপন্যাস, ৫ খণ্ডে টোকাই, ১ টি শিশুতোষ উপন্যাস, ১ টি প্রবন্ধ সংগ্রহ৷

আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ:
অংশগ্রহণ করেন ১৯৮৭ সনে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ইউনিসেফ কর্তৃক আয়োজিত চাইল্ড সারভাইভাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক সেমিনারে, ১৯৯৭ সনে তুর্কির ইসতান্বুলে অনুষ্ঠিত ফোক আর্ট-সংক্রান্ত সেমিনার ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনুষ্ঠানে, ১৯৯৪ সনে ভারতে বাংলাদেশ কালচারাল ফেস্টিভালে এবং ১৯৯৬ সনে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত শিশুশ্রম বিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে অন্যতম বিচারক হিসেবে৷

পুরস্কার:
একুশে পদক-১৯৯৩, চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি অ্যাওয়্যার্ড-১৯৮৯, শিশুদের বই ডিজাইনের জন্য অগ্রণী ব্যাংক অ্যাওয়্যার্ড-১৯৯২, ১৯৯৫; ১৯৬৮ থেকে ১৩ বার ন্যাশনাল বুক সেন্টার পুরস্কার লাভ, অলিম্পিক চারুকলা প্রদর্শনী-২০০৮এ ৩০০ জন ‘এক্সিলেন্ট আর্টিস্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর মধ্যে একজন হিসাবে মনোনীত৷

লেখক : মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব