সময়
কর্পোরেট জীবনের বর্ণালী আঙিনায় দিন দিন গৌণ হয়ে যাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। তার জৌলুস ছিনিয়ে নিচ্ছে জীবনের ছোট ছোট সুখগুলোকে। ইচ্ছে থাকলেও সময় মতো ফেরা হয় না একান্ত নিজের বৃত্তটিতে। অন্যদের চোখে কিভাবে নিজকে আরো ঈর্ষনীয় করে তোলা যায়, বৈভবের দিক দিয়ে নিজের আশপাশ কতটা আরো উঁচুতে উঠিয়ে নেওয়া যায়, সেই বাসনাই যেন রাত্রিদিন ঘুরপাক খায় মনের ছোট্ট নদীটিতে। যে ঘূর্ণিতে খাবি খেতে খেতে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় ছোট ছোট কচুরিপানা, দূর কোনো গ্রাম থেকে উড়ে আসা খড়-কুটো আর পাখির পালকের মত আবেগ, প্রতিশ্রুতি, ভালোবাসার বর্ণালী প্রজাপতিদের সুকোমল দেহ।
তেমনই একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী আর অক্লান্ত পরিশ্রমী পার্থ প্রতিম হক। যার সপ্তাহটা কেটেছে খুবই ব্যস্ততায়। যে কারণে ঘরের দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারেনি সে। ঘর বা গ্রাম থেকে যে ক’টি ফোন এসেছে সব কটিই কেটে দিয়েছিলো। একটি মিটিঙে থাকার সময় গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট বোন চায়না কী কারণে বেশ ঘন ঘন ফোন করছিলো। প্রথম কয়েকবার ফোন কেটে দিলেও পরের বার নিজেই ফোন দিয়ে জানিয়েছিলো, ঘণ্টা খানেক বাদে ফোন করছি! তারপরই ফোনটার সুইচ অফ করে দিয়েছিলো সে। ভাই-বোন বাবা-মা কেউ তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে চাইলে এই নাম্বারেই কল করে থাকে। মিটিং সেরে পার্টিতে যাওয়ার পর সবার পাল্লায় পড়ে এক আধ পেগ করে করে পরিমাণের দিক দিয়ে বেশ খানিকটা টেনে ফেলেছিলো। যার ফলে বোধ বিচারহীন পার্থ কে হোটেলের একটি রুমে নিয়ে কোনো রকমে মান বাঁচায় টিনা।
সকালের দিকে নিজেকে ভিন্ন জায়গায় আবিষ্কার করতে পেরে সেখান থেকে পালানোর জন্য দ্রুত তৈরি হয়ে বেরোবার আগখান দিয়ে বাথরুম থেকে টিনাকে বের হতে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠেছিলো সে। তখনই তো তো করে বলে উঠেছিলো, ‘আপনি এখানে?’
টিনা হেসে উঠে বলেছিলো, ‘হ্যাঁ স্যার আমি! এখানে আমি ছাড়া আপনাকে দেখার কে আছে?’
‘কী হয়েছিলো?’
‘তেমন কিছু না। কাল রাতে পার্টিতে গিয়েছিলেন।’
‘তাহলে বাসায় না গিয়ে এখানে কেন?’
পার্থর বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই টিনা বলে উঠলো, ‘কাল রাত্রি বেলা এতটাই টেনেছেন যে, স্ট্রেচার বা অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আপনাকে কিছুতেই নেওয়া যেতো না। তা ছাড়া এ অবস্থায় আপনাকে বাসায় নিয়ে গেলে ভাবি বা বাচ্চারা কি মনে করতো?’
পার্থ মনে মনে খুশি হলেও তা হাব ভাবে প্রকাশ হতে দেয় না। তার বাইরের এসব ব্যাপারে রুনা কিছুই জানে না। সে জানে যে, তার প্রিয় মানুষটা কাজের পেছনেই ছুটছে দিনরাত, তার এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য। মদ খেয়ে মাতলামি করা বা মদে চূর হয়ে বেহুঁশ অথবা গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া পার্থকে দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না রুনা। ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট আর সহজ-সরল রুনা এসব জানলে বা দেখতে পেলে চরম ঘৃণায় হয়তো তাকে ছেড়েই চলে যাবে। রুনাকে সে যতটা না ভালোবাসে তার চেয়ে ভয়ই যেন পায় বেশি। আর এই ভয়টা তাকে ঘরের ভেতর একজন শুদ্ধ মানুষের আচরণ করতে বাধ্য করে। বাচ্চারা বন্ধুর মতো বাবাকে চোখের আড়াল করতে চায় না। কিন্তু প্রয়োজন তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় মাঝে মাঝে।
‘স্যার কি ভয় পেয়েছেন?’
টিনার কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসে পার্থ। গত রাতটা যদি টিনা তার সাথেই থাকে, তাহলে আরো বড় বিপদের জন্য তৈরি থাকা ভালো। শোনা যায় আগের এ এম এই নারীর খপ্পরে পড়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বেচারা এখন গ্রামে গিয়ে মুরগির খামার দিয়েছে। এখন তার কপালে কী আছে ঈশ্বরই ভালো জানেন। গোপনে ছবি-টবি তুলে থাকলে বা মোবাইলে ভিডিও করে রাখলে তাকে মুঠোয় পুরে রাখার মতলব আঁটবে না তো?
শেষটায় পার্থ যেন ঝাঁকি দিয়ে মাথা থেকে যাবতীয় সন্দেহ আর ভয় ঝেড়ে ফেললো। বললো, ‘আপনি যাবেন না? আমার এখনি বাসায় যেতে হবে!’
‘বাসায় তো যাবেনই। একটা রিকোয়েস্ট আছে স্যার!’
পার্থ আরো অবাক হয়ে তাকায় টিনার দিকে, ‘বলেন!’
‘আমরা যে কাল রাতে এখানে ছিলাম কেউ যেন জানতে না পারে।’
‘কীভাবে জানবে?’
‘ভাবীকে হোটেলের কথাটা বলবেন না।’
‘আচ্ছা, বলবো না। আপনি কি আমার সঙ্গে বেরুবেন?’
‘না স্যার। দু হাজার টাকা দিয়ে গেলে ভালো হতো।’
‘পার্থ হেসে উঠলো। হোটেলের বিলটা আমি দিয়ে দেবো। ভাববেন না।’
‘সে জন্যে না। আমি একা বলে রুম নিয়েছি। নিজের আসল নামে রেজিস্টারে সাইন করেছি!’
পার্থ কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘ঠিক আছে।’ তারপর বিছানার ওপর দুটো এক হাজারী নোট রেখে প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে হোটেল থেকে।
বাসার মূল দরজায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ বেল বাজালেও কেউ দরজা খুলতে এলো না। সে অবাক হয়ে ভাবলো, তাহলে কি রুনা বাসায় নেই? চাবি লাগিয়ে দরজা খুলতে খুলতে সে মনে করতে চেষ্টা করে যে, বাচ্চাদের নিয়ে রুনার কোথাও যাওয়ার এমন কোনো প্রোগ্রাম ছিলো কি না। কিন্তু মনে করতে পারে না। ঘরে ঢুকে রুনাকে ফোন করার জন্যে পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই দেখতে পায় বন্ধ। কেন বন্ধ? ব্যাটারির চার্জ কি ফুরিয়ে গেছে?
ফোনটা অন করতেই চার্জ ফুল দেখতে পায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই রুনার নাম্বার টিপে কল দেয়। রুনা যেন পার্থর ফোনের জন্যে মুখিয়ে ছিলো। একবার রিঙ হয়েছে কি হয়নি সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ করে সে বলে উঠলো, ‘হ্যালো, কোথায় তুমি?’
‘এই তো বাসায়? ফিরবে কখন? কোথায় আছ?’
‘আমি মৈশান বাড়ি। তুমি এক্ষুনি চলে আস! রাখি!’
রুনা কিছু একটাতে ব্যস্ত মনে হলো। কিন্তু সেখানে সে করছে কি? এমনিতেই লোভ দেখিয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়েও সেখানে তাকে নেওয়া যায় না বছরে একবার, আর তেমন একটা জায়গায় সে নিজ থেকেই গেল? কী এমন কারণ থাকতে পারে?
ভাবতে ভাবতে পার্থ পুনরায় দরজায় চাবি লাগিয়ে তালা আটকে নিচে নেমে আসে। গাড়ি নিতে ইচ্ছে হয় না। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো। একটি ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে। আজকাল ভালো কোনো ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। মনে হয় সবই লক্বর-ঝক্বর মার্কা। রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি কালো ট্যাক্সি পেয়ে তাতেই চড়ে বসলো সে।
বাড়ি পৌঁছুতেই অনেক আত্মীয়ের দেখা পেয়ে যার পর নাই অবাক না হয়ে পারে না সে। এমন কি যারা সাধারণ উৎসব-পার্বণে নিমন্ত্রণ পেলেও আসে না তেমন মানুষদের দেখতে পেয়ে মনটা খুত খুত করতে লাগলো।
মা তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন। চায়না চোখে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বড় ফুপু চোখের জলে গাল ভাসিয়ে বললেন, ‘বাপ, তোরা কী এমুন কাজ করস যে, বাপ মা মরলেও মাটি দেওনের সময় হয় না? এমন কিনা গোলামের মতন কাজ না করলে কী অয়?’
বাবার অসুখ এ কথা শুনতে পেয়েছিলো রুনার কাছে। কিন্তু সেই অসুখেই বাবা ফুরিয়ে যাবেন কে জানতো? তাকে জড়িয়ে বিলাপ রত নিরাভরণ মায়ের পরনে পাড় বিহীন সাদা শাড়ি দেখে ব্যাপারটা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি মোটেও। কিন্তু বড় ফুপুর কথায় তার দু চোখ ভিজে এলেও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। শব্দরা যেন একই সঙ্গে বেরুতে গিয়ে গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আটকে গেছে।
(সমাপ্ত।)
জুলাই ৩, ২০১১।
(সৃজন ই-গ্রন্থে প্রকাশিত)
11 Responses to সময়
You must be logged in to post a comment Login