রাবেয়া রব্বানি

অণুগল্পঃ-বাক্স

অণুগল্পঃ-বাক্স
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বাক্স
রাবেয়া রব্বানি

-নাম কামের ব্যাপারটা পুরোপুরি কপাল বুঝলেন। তবে কি কপাল ভালোর দিকে গড়ালেও আমাদের কিন্তু একটু বুঝে চলতে হয়। তাই না?
-তাতো ঠিক।
-আরে আপনি জানেন রফিক সাহেব? আমি আমার ২০ বছরের প্রকাশনা জীবনে দেখেছি অনেক ভালো লেখক, মানে শুধু ভালো লেখেন তা না ইন্টেরেস্টিং করেও লিখেন তবু তাদের বই কখন বাজারে এলো বা চলে গেল কেউ জানলো না।
-আচ্ছা।
-পাবলিসিটি করেও কাজ হয় না। যেমন আপনার ভাগ্যের চাকাটাও হঠাৎ ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু এটাকে এখন ঠিকঠাক চলতে দিতে হবে। ঠিক বলেছি না?
এবারো সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন রফিক সাহেব। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না প্রকাশক জহির আহমেদ তাকে কেন আজ তার নিজ বাড়িতে ডেকে এনেছেন আর কেনইবা এগুলো বলছেন।
-রফিক সাহেব আপনার আরলি বইগুলোর রেসপন্স এখনো বেশ ভালো। কেন জানেন?
-কেন?
-কারন বইগুলো প্রেম বিষয়ক। বইগুলোর নামেই একধরনের চটক থাকে। প্রেম বিষয়ক বই কাটতি মানেই কিন্তু কেল্লাফতে না। এই ধরনের বই খুব বিক্রি হয় লাভ গিফট হিসাবেই শুধু তাছাড়া উঠতি বয়সের অপাঠক দ্বারাও। কোন বই অপাঠক কর্তৃক প্রিয় হলেই আমরা ধরে নেইনা যে লেখকের জনপ্রিয়তা টেকশই।
রফিক সাহেবের সামনে এক কাপ চা দেয়া হয়েছে। জহির সাহেবের এই কথায় তিনি তাতে হাত দিতে গিয়েও দিলেন না। বিরক্তি চেপে মুখে বললেন,
-আমি বুঝতে পারছি না। আপনি আসলে কিছু বলতে চাইছেন। সরাসরি বলতে পারেন।
আর মনে মনে বললেন,
-তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ।শালা কাগজের ব্যাবসায়ী।
জহির সাহেব যেন তার মন পড়তে পারলেন এভাবে বললেন,
-শোনেন, আপনি লেখক আর আমি সাধারণ ব্যবসায়ী হলেও সাহিত্য জ্ঞান আমার আছে। আর আমার আর আপনার স্বার্থ কিন্তু এক। আমি ও আপনি দুই জনই চাই বইটা চলুক। শুনেছি আপনি চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছেন। তাহলে বুঝুন বই চলাটা আপনার জন্য এখন একটা ইম্পর্টেন্ট ইস্যু।
রফিক সাহেব কিছু বলার আগেই জহির সাহেব তাকে থামালেন।
-আপনার লেখা আমরা নিচ্ছি দুই বছর ধরে। আমি নিজ হাতে অনেক লেখক তৈৈরি করছি।নিজ স্বার্থে তাদের উপদেশ দিয়েছি আর তাতে তাদের কোন ক্ষতি হয় নি। তবে তাদের নাম হয়ে গেলে আবার তাদের চাটুকারীই করি। হা হা। একদিন হয়ত আপনার বাড়ি গিয়েও আমি বসে থাকব লেখার জন্য।
জহির সাহবের হাল্কা রসিকতায় ও রফিক সাহেবের মুখ সহজ হলো না। তার বলতে ইচ্ছে করল,
“তুই কিভাবে লেখক তইরি করেছিস? তুই পেটমোটা ব্যবসায়ী তুই তো গড না।
কিন্তু এরকম কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। তিনি যথাসম্ভব সহজ থাকার চেষ্টা করলেন। শান্ত গলায় বললেন,
-আপনি আমাকে আজ কেন ডেকে এনেছেন বুঝতে পারছি না। আজ আর তো কাউকে দেখছি না। আড্ডা টাড্ডা হবে বলেও তো মনে হয় না।
জহির সাহেবের মুখটাও এবার কিছুটা গম্ভীর হল।তিনি শব্দ করে ড্রয়ার খুললেন।একটা পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে রফিক সাহেবের হাতে দিলেন।
-আপনি এক সপ্তাহ আগে আমার অফিস এ গিয়ে আমার সেক্রেটারীকে এই পান্ডুলিপিটা প্রকাশের জন্য দিয়ে এসেছেন।
-হ্যা।
-সরাসরি প্রকাশের জন্য লেখা দেয়াটা এখনো আপনার জন্য ঠিক না। আমরা ধরে নিয়েছি আপনি লেখা জমা দিয়েছেন।যদিও আপনার লেখাটা ক্লাসি লেখা এটা মানছি। কিন্তু এটা পাঠক খাবে না।
-আপনি কিভাবে এটা বলেন? আমার বিগত সবগুলো বই বাজারে চলেছে।
-কিন্তু এটা চলবেনা। এটার প্রশংসা হবে বোদ্ধা মহলে তবে টাকা আসবে না। এই মূহুর্তে আমার আপনার দুজনের টাকাটাই বেশি দরকার।
-আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। ক্লাসি লেখা কেন চলবে না। লোকে এখনো শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের গল্প কিনে।
-হ্যা তা কিনে তবে তা ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য কিংবা বিয়েতে সস্তা উপহারের জন্য। দেখবেন এগুলো খুব কমদামী প্রিন্টে করা।পড়ে কয়জন? তাছাড়া তাদেরটা কিনলেই আপনার অফ মুডের ক্লাসি লেখা কিনবে কিভাবে ভাবলেন? আপনি আর তারা তো এক না। হা হা। তবে হ্যা যখন জনগনের একটা এবারেজ পারছেনটেজ আপনার লেখা ঘরে সাজিয়ে রাখবেন ঠিক তখন হবে লেখাটির ছাপানোর সময়।
রফিক সাহেব খুব কষ্ট করে তার আহত আত্মমর্যাদা লাগাম দিচ্ছেন। কিন্তু আসলেই আপাতত সেও নিরুপায়। লেখার চাপে বেসরকারী চাকুরীটা ছাড়তে হয়েছে। বই লিখে আগের চেয়ে বেশ ভালোই কামান। আর তাতে স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে আগের চেয়ে ভালোই আছেন। তার মানিব্যাগে এখন টাকা গুনতে হয় না। লেখক পরিচিতি ও এখন ঊঠতি। সামাজিক মর্যাদাও আগের চেয়ে অনেক। এ অবস্থায় একজন প্রতিষ্টিত প্রকাশককে মুখের উপর তিনি কিছুই বলতে পারেন না। তবু চেষ্টা করেও তিনি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারছেন না। কেন যেন তার বুকের মধ্যে কষ্ট উথাল পাথাল করছে। তার মুখ দেখে মনের অবস্থা যে কেউ পড়তে পারবে আর জহির সাহেবতো ঘাঘু প্রকাশক। সহমর্মিতায় হয়ত জহির সাহেব এবার এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন,
-ভাই আমার কথায় মনে কিছু নিয়েন না। পান্ডুলিপিটা নিয়ে যান। আপনার কাছেই রাখুন এখানে হারিয়ে যাবে। আসলে সব কিছুর একটা সময় আছে। এক দু বছর পর সময় হলে একুশে বইমেলার আগে ছেপে দিব। একটা পুরস্কার টুরস্কার ও পেয়ে যেতে পারেন।
জহির সাহেব চোখ ছোট করে মুচকি হাসছেন আর তার চকচকে টাকে হাত বুলাচ্ছেন। রফিক সাহেব হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু হাসতে পারলেন না। লেখাটার প্রতি তার মমতা অসীম। দুই তিন বছর ঘষামাজা করেছেন। নিজের সবটুকু কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে তিল তিল করে গড়েছেন এটাকে।এই লেখাটা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তিনি এটা মানতে পারছেন না।
তিনি মন খারাপ করেই পান্ডুলিপিটা নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলেন।সন্ধ্যা নেমে গেছে বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। উষ্ণতার জন্য পান্ডুলিপিটাই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আশেপাশে খালি রিকশা ক্যাব বা সিন এন জি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব যাত্রি নিয়ে ঘর ফিরতি পাখির মত হুশহাশ ছুটছে। তিনি হাঁটতে লাগলেন। তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি দশটি প্রকাশিত বইএর লেখক রফিক সাহেব না। তিনি সাত আট বছর আগের সেই রফিক যে টিউশনি শেষে মাঝে মাঝে পান্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশক বা সম্পাদক পাড়ায় ঢু মারতেন। পকেটে টাকা থাকতো না। প্রত্যাখাত পান্ডুলিপিটা নিয়ে তখন ঠিক এমনি হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতেন। আজ তার পকেটে টাকা আছে তবু তখনকার সন্ধ্যাগুলোর মত আজ আবার তিনি ফেরত দেয়া পান্ডুলিপি নিয়ে পায়ে হাটছেন। রফিক সাহেবের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। তার মনে হলো,মানুষের জীবনের কিছু কিছু অসহায়ত্ব বোধ ঠিক একি চেহারা নিয়ে বার বার ফিরে আসে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


17 Responses to অণুগল্পঃ-বাক্স

You must be logged in to post a comment Login