ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৬)
ছয়
“ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনের গণপিটুনিঃ একজনের মৃত্যু”
“রাহধানীতে র্যাবের গুলিতে যুবক নিহত”
“যাত্রাবাড়ীতে তিন খুনঃ মূল পরিকল্পনাকারী নিহতের দুই ভাই”
“মোহাম্মাদপুরে ছেলের হাতে মা খুন”
সাখাওয়াত সাহেব দৈনিক পেপারটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলের এক কোনায়। খুন-খারাবি ছাড়া আজকাল পেপারে কিছুই থাকে না। সকালবেলাতেই মন মেজাজ দুইই খারাপ করে দেয়। অবশ্য আজ সকাল থেকে এমনিতেই তার মন খারাপ।
সাখাওয়াত সাহেব অফিসে বসে আছেন। চার পাঁচটা ফাইল এদিক ওদিক ছড়ানো, চোখ বুলিয়ে এলোমেলো করে রেখেছেন তিনি। সকালবেলাতেই উনার পিএ ফাইলগুলো সিগনেচার করাতে নিয়ে এসেছিল, সাখাওয়াত সাহেবের মেজাজ এতই খারাপ ছিল যে পিএকে অযথায় একটা রাম ধমক দিয়েছেন। পিএটা চাকরিতে নতুন, ধমকের সাথে তার হাত পা ভীষন কাঁপছিল। এভাবে ধমক না দিলেও হত, ভাবেন সাখাওয়াত সাহেব; সাধারনত তিনি কারও সাথে এরকম করেন না। সত্য কথা বলতে কি, আজ উনার মনটা সত্যই বেশিই খারাপ। গাড়ীতে করে অফিসে আসার সময় উনার এক আত্নীয় কল দিয়েছিল উনাকে, সেই আত্নীয় নাকি ওলিকে কোন ছেলের সাথে রিক্সায় ঘুরতে দেখেছে। তারপর থেকেই মনমেজাজ খারাপ সাখাওয়াত সাহেবের। কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তিনি চান না, নিলা যা করেছে ওলিকে তা কিছুতেই করতে দিবেন না। তিনি ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা হাতে নি্যে জাহানারাকে ফোন দিলেন।
-হ্যালো?
-হুম। আমি সাখাওয়াত, তোমার মেয়ে কোথায়?
-ও তো ভার্সিটি গেল এখন।
-শুধুই কি ভার্সিটি?
-হ্যাঁ। তাইতো বলে গেল।
-মেয়ে কোথায় যায়? কি করে খোঁজ রাখ?
-হঠাৎ এ কথা? ও যেখানে যায় আমাকে বলেই তো যায়।
-শুন রাখ ভাল করে, তোমার জন্য নিলা যা করার সাহস পেয়েছিল তা যদি ওলির বেলায় হয় তবে আমি তোমাকেই দায়ী করব।
-কেন কি হল হঠাৎ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-খোঁজ খবর কর মেয়ে কোথায় যায়।
এরপরই ফোনের রিসিভার খটাস করে নামিয়ে রাখলেন। জাহানারার উপর রাগ ফোনের উপর ঝাড়ার চেষ্টা করলেন, নিলার ব্যাপারটা নিয়ে জাহানারাকে আজও ক্ষমা করতে পারেন নাই তিনি। কিছুক্ষন ফোনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন, সেদিকে তাকিয়েই একটা সিন্ধান্ত নেন তিনি। ফোনের রিসিভারটা আবারো উঠিয়ে রিসিপসিনিষ্টকে নবীকে পাঠাতে বললেন। নবী হচ্ছে সাখাওয়াত সাহেবের স্যারের ছেলে, ছোটবেলায় উনাকে পড়াতেন। প্রায় সাথে সাথেই নবী সাখাওয়াত সাহেবের ঘরে এসে উপস্থিত হল।
-স্যার আমাকে ডেকেছেন?
-হুম আস, বস।
সাখাওয়াত সাহেব নবীকে বসতে দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন যেন দম নিচ্ছেন। যে কাজটা উনি করতে যাবেন, সেটা ওলি জানতে পারলে কষ্ট পাবে তবু তিনি সেটাই করতে চান। তিনি বারবার পরাজিত হতে চান না।
-তোমাকে একটা কাজ করতে দিব নবী, খুব সাবধানে করতে হবে; যেন কেউ টের না পায়।
নবী যখন ভ্যাগাবন্ড হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পাস কোর্স পাশ করে, তখন সাখাওয়াত স্যারই ধরে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাই স্যারের জন্যে জানটা দিয়ে দিতে পারে সে। আর স্যার কিনা এমনভাবে বলছেন যে নবী না বললেই কাজটা তাকে করতে হবে না। নবী গলায় অতিরিক্ত জোর দিয়ে বলল,
-আদেশ করেন স্যার।
সাখাওয়াত সাহেব আবারো দম নিলেন। সংকোচ হচ্ছে উনার।
-আমার মেয়েকে সাত-আটদিন ফলো করবে তুমি। কোথায় যায়? কি করে? কার সাথে থাকে? এগুলো রিপোর্ট করবে আমাকে।
নবী মুখে কিছু বলে না। উপরে নিচে মাথা ঝাঁকায়।
-কাল থেকেই করবে, অফিসে এসে সিগনেচার করেই বের হয়ে যাবে। আমার মেয়েকে চিন তো?
-জ্বীনা স্যার।
-মানে ওলি কখনো তোমাকে দেখেনি?
-না স্যার, উনার সাথে আমার কখনো পরিচয় হয়নি।
-সেটাই ভালো। কালকে সকালে এসেই আমার কাছে এস, ছবি দিয়ে দিব; কোথায় ক্লাস করে ডিটেইলস দিয়ে দিব।
-ওকে স্যার।
-ঠিক আছে এখন আস।
নবী চলে গেলে সাখাওয়াত সাহেব অফিসের শোয়ার ঘরে গেলেন। নিজের অফিস, রুমের সাথেই লাগায়ো একটা ঘরে তিনি শোয়ার জন্য বিছানা রেখেছেন; এমনকি একটা টিভিও আছে। উনার মাথার পিছন সাইডে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়েছে; সম্ভবত প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। শোবার ঘরে শুয়ে টিভিটা অন করলেন, ডিসকভারি চ্যানেলটাই প্রায় সময় দেখেন তিনি। এখন সেখানে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দেখানো হচ্ছে, একটা পিস্তলের বুলেট কাঁচ ভেদ করে কত দ্রুত যেতে পারে এ জাতীয় কিছু একটা। তিনি মনযোগ নিয়ে দেখতে লাগলেন। বেলা এগারটার দিকে সাখাওয়াত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন, নিঃশব্দটা টিভিটা দর্শক ছাড়া বাজতেই থাকল।
ঘুম ভেঙ্গে মোবাইলে সময় দেখেই চমকে উঠলেন, চারটা বেজে গিয়েছে। এতক্ষন কিভাবে ঘুমালেন, ভাবলেন সাখাওয়াত সাহেব। ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং ছিল, মিস করেছেন। পিএটাকে ভাল করে শিখিয়ে নিতে হবে নাকি বদলিয়ে একটা মহিলা পিএ রাখবেন? তবে মাথা ব্যাথাটা কমে গিয়েছে, শরীরটাও ঝরঝরে লাগছে। শুয়ে থেকেই ওলিকে একটা কল দিলেন।
-হ্যালো বাবা?
-হুম, কোথায় তুমি?
-তোমাকে কাল বললাম না?
-বলেছিলি নাকি? মনে নেই।
-ধুর, আজকাল তোমার কিছুই মনে থাকে না। কয়েকদিন আগে আমার এক বান্ধবীর গায়ে হলুদ ছিল মনে নেই, আজ তার বিয়ে। আমার বাসায় যেতে আজ একটু দেরি হবে বাবা, গাড়িটা আজ সারাদিনের জন্যে রেখে দিয়েছি আমার কাছে।
-ভাল করেছ। গাড়ি ছাড়া কোথাও যাবে না।
-আচ্ছা বাবা।
-দেরি হবে মাকে জানিয়েছ?
-হ্যাঁ। ফোন করে দিয়েছি। সকালে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
-ঠিক আছে রাখছি। সাবধানে থাকবে।
-আচ্ছা বাবা, তুমি কোন চিন্তা কর না।
ওলি ওর বান্ধবীর বিয়েতে যাওয়ার সময় নিলার বাসায় এসেছে সদ্য। সেখান থেকেই ফোনটা রিসিভ করেছে। নিলা খালার বাসায় এসেছে শুনলে বাবা অনেক রাগ করতেন। নিলাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল,
-খালা, তোমার খবর বল?
-ভাল। তুই কেমন আছিস? শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে?
-ধুর, দিন দিন আরো মোটা হচ্ছি, আর তুমি বলছ শুকিয়ে গিয়েছি।
-তারপর, বাসার খবর ভাল? ভাইয়া ভাবি ভাল?
-হুম, সবাই খুব ভাল আছে।
ব্যাগ থেকে আচার বের করে নিলার সামনে রাখে ওলি।
-ধর, তোমার জন্যে আচার এনেছি; মা দিয়েছে।
নিলা ধমক দেয় ওলিকে। বলে,
-তুই এগুলো আনতে গেলি কেন?
-বারে, আমি কিছু আনতে পারব না কেন? আর তোমার জন্যে আনিনি তো, এনেছি আমার ছোট্ট ভাইটার জন্যে।
-ভাই হবে কিভাবে বুঝলি? তুইও তাহেরের দলে?
ওলি হাসে। বলে,
-আমি জানতাম তুমি রেগে যাবে।
-মোটেও রাগিনি আমি।
-নাতো কি?
-তোদের কথা মত হবে নাকি সবকিছু?
-এইতো রেগে গিয়েছ। খালু কখন আসবে?
-ওতো আজকাল আটটা নয়টার আগে ফিরে না।
-কেন?
-অফিসে কাজ বেশি মনেহয়।
-আহারে, তোমাকে সারাদিন একা থাকতে হয়।
তাহেরের টিউশনির কথা ওলিকে বললে কোন সমস্যা নেই, তবু জানাতে চাই না নিলা। সবাইকে আজ দূরের মানুষ মনে হয়, কাউকে মন খুলে কথা বলতে পারে না।
-খালা আজ তাহলে উঠি?
-এখনি চলে যাবি, আরেকটু সময় থাক; তুই তো আসিসই না আজকাল।
-আসব খালা। তবে আমাকে এখন যেতে হবে, ওদিকে আমার বান্ধবীরা বিয়ের অনুষ্ঠানে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
-ঠিক আছে আয় তবে।
-আচ্ছা।
ওলি ব্যাগ ঘাড়ে নিয়েই দ্রুত নিচে নেমে আসে। গাড়িতে করে যেতে যেতে রফিকের কথা ভাবে ওলি। সেদিন রফিকের উপর রাগ করে চলে এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিল ঠিকই করেছে পরে অবশ্য মনটা ছটফট করেছে ওকে দেখার জন্যে। রফিক কেন যে সেদিন গেঞ্জিটা নিতে চাইল না? নিতে চাইলে তো এভাবে রেগে চলে আসতে না সে, কত কথা ছিল বলার; কিছুই বলা হয়নি। রফিক কি ঠিক এখনো ওকে বুঝতে পারেনি, অভিমান হয় ওলির; চোখগুলো কান্নায় ছল ছল করে উঠে।
ওলির বান্ধবী মিতার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে গুলশানের এক বিরাট কমিউনিটি সেন্টারে। সিঁড়িতেই লিপির সাথে দেখা হয়ে যায়। সিডিতে হিন্দি, ইংলিশ গান বাজছে। কথা বলতে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে।
-কিরে ওলি? তুই এত খারাপ কেন?
-কেন? আমি আবার কি করলাম?
-তোকে কতবার করে বলে দিয়েছিলাম তাড়াতাড়ি আসার জন্যে আর তুই কিনা সবার পরে এলি? তুই কি মানুষ?
-মাফ দে। খালাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাই মিরপুর গিয়েছিলাম।
-ও। আচ্ছা ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি চল; বিউটি পারলার থেকে বিউটিশিয়ান নিয়ে এসেছি সাথে আমরা সবাই মিলে মিতাকে সাজাবো।
-চল।
ঘরে সব বান্ধবীকে দেখে মনটা নেচে উঠে ওলির। সেই স্কুলের বান্ধবীরাও আছে সেখানে, চারিদিকে গোল করে ঘিরে রেখেছে মিতাকে; অকারনেই হেসে উঠছে সবাই আর একে অপরের শরীরের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। লিপি একটু শয়তান টাইপ মেয়ে হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। সে বলল,
-মিতা, তোকে এত সাজিয়ে কি লাভ বলত?
মিতা কিছু বলে না। অন্যেরা প্রতিবাদ করে, বিয়েতে সাজতে হবে না?
-না মানে, কিছুক্ষন পরে তো মিতার বর এই সাজুগুজু নষ্ট করে ফেলবে। তাহলে সেজে লাভ কি?
সবাই এবার লিপির কথার অর্থ ধরতে পারে। একসঙ্গে সবাই হো হো করে হেসে উঠে। ওদের মধ্যে একজন আবার লিপির কথার পিঠে কথা বলে উঠে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে,
-কেনরে লিপি, মিতার বর মিতাকে কি করবে?
-ইয়ে করবে, ইয়ে।
আবার সবাই একচোট হেসে ফেলে। ওলিও হাসে, তবু যেন সে ওখানে থেকেও নেই। রফিককে কত কথা বলার ছিল, কিছু বলা হয়নি। ওলি রফিকের মেসটাও চিনে না। ওলির মন রফিকের জন্যে কেঁদেই চলে। এবার রফিকের মেসটা অবশ্যি চিনে রাখবে সে যেন ইচ্ছা হলেই যেতে পারে।
One Response to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৬)
You must be logged in to post a comment Login