জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১৪

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ভোর হওয়ার আগেই নিশিন্দার জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিতে কেমন সাজসাজ রব পড়ে যায়। প্রতিটি সদস্যই যেন ধনুকের ছিলার মত টানটান হয়ে আছে উত্তেজনায়। যাদের অধিকাংশই যেন একটু ঢিল পেলেই ছুটে যাবে তীরের মত।

হাসন আলি হঠাৎ লক্ষ্য করলো, কাশেম হাবিলদার কেমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। ঠিক তখনই হাপাতে হাপাতে ছুটে আসে দেলু আর ফালু। অন্ধকারে দূরের হ্যারিকেনের আলোয় তাদের মুখ কেমন চকচকে দেখায়।

হাবিলদার হাসন আলির মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেলু আর ফালুর দিকে তাকান।

ফালু তখনই বলে উঠলো, আইজগা দেখলাম একটা ছোড কলের নৌকা ফটফট কইরা ইস্কুল ঘরের কাছে গাঙ্গে আইয়া থামলো!

কী দেখলি? হাবিলদারের কণ্ঠে আগ্রহ ফুটে ওঠে।

অনেক বাকস নামাইলো হেই নৌকার থাইক্যা!

বাক্সে কী আছে তা যদি কইতে পারতি তাইলে বেশি কাম হইতো!

কইলে তাও চুরি কইরা আনতে পারমু!

আলিম বক্স রেগে উঠে বললো, সব জিনিসই চুরি করন যায় না, গাধা কোনহানকার!

ব্যথা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে হাবিলদার বলে উঠলেন, আর সময় নাইরে পাগল! অখন কে বাঁচিমরি তার কোনো ঠিক নাই!

তারপরই ফের দিয়াশলাইর কাঠি জ্বেলে কব্জিতে বাঁধা ঘড়ি দেখে তিনি বলে উঠলেন, সব মিলাইয়া দেড়ঘন্টা সময় পাইবা। তারপরেই সুরুজ উঠবো। এই সময়টা খুবই কঠিন! চাইরো দিক আলো হওনের আগে পৌঁছাইতে না পারলে সব কিছু শেষ হইয়া যাওনের সম্ভাবনা। কিন্তু হিসাব কইরা দেখছি কোণাকুণি হাঁটলে পোণে এক ঘন্টা কি এক ঘন্টার মধ্যেই যাওন যায়। খুব হিসাব কইরা অ্যামবুশ নিবা! কোনোরকমেই জানি মাথাগরম না হয়। আমরা টার্গেট করমু পাইক্যারা ঘুম থাইক্যা উইঠ্যা যখন টাট্টির সামনে লাইন দিবো। এই সময় পাহারায় বেশি না থাকলেও অনুমান করি মেশিনগান সাব-মেশিনগানে কেউ না কেউ থাকবো। কাজেই আমরা কোনো ভুল করন যাইবো না। আমার বাঁশি না বাজলে কেউ গ্রেনেড চার্জ করবা না!

দলটি টানটান হয়ে অপেক্ষা করছিলো পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্য। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, আলিম তোমার দল নিয়া আগাও!

বিস্মিত আলিম বক্স বলে উঠলো, আমরা মতিউর রহমানের বাড়ির দিকে যামু না ইস্কুলঘরের দিকে যামু?

তোমরা ইস্কুলের পিছে যেই ঢালু জাগাটা আছে সেইখানে অ্যামবুশ নিবা। মিরধা রেকি কইরা আসছে। আবারো বলি, আমার বাঁশি না শুনলে কেউ গ্রেনেড চার্জ করবা না! খবরদার!

শুষ্ক কণ্ঠে আলিম বক্স বলে উঠলো, তাইলে আমরারে যদি আগে অ্যাটাক করে?

তোমার গ্রুপের কমান্ডার তুমি। তখন আমার আশায় থাকবা না। গুলি করবা! তোমার চাইনিজ রাইফেলের গুলি শুইন্যা বুঝবো তোমরা সমস্যায় আছ। অবস্থা বুইঝ্যা অ্যাকশানে যাইবা!

আলিম আর তার দলকে নির্দেশ দেওয়ার পর হাবিলদার কাশেম মাথা ঘুরিয়ে তার পেছনে দাঁড়ানো দল দুটোকে দেখে নিয়ে ফের আলিমের দিকে হাত তুলে বললেন, ফলিং অন!

আলিম বক্সের পেছনে হাসন আলি হোসেন মৃধা চান্দভানু মমতা আর জুলেখা মাটিতে সজোরে পা ঠুকে একের পেছনে একজন করে একই সারিতে দাঁড়িয়ে পড়লে বাধ্য হয়েই আলিম বক্সকে বুকটান করে দাঁড়াতে হয়।

হাবিলদার ফের আদেশ দেন, অ্যাবাউট টার্ন!

মুহূর্তেই ছ’জনের দলটি উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখনই চূড়ান্ত নির্দেশ শুনতে পায়, ফরোয়ার্ড মার্চ!

দলটির আর কিছুই করার থাকে না। নিশন্দার জঙ্গল ছেড়ে তাদের বেরোতেই হয়। চলতে চলতে আলিম বক্স বললো, মাইয়াগো কোমরে গ্রেনেড আছে তো?

চান্দভানু জানায়, আছে!

কয়টা কইরা?

আমার হাত ভালো দেইখ্যা আমারে দিছে চাইরটা।

আর অন্যরা?

জুলেখা বললো, আমি আর মমতা দুইটা কইরা!

আলিম বক্স এবার হোসেন মৃধার উদ্দেশ্যে বললো, কাকুর কয়ডা?

হাসন আলি বললো, বাবার কাছে গ্রেনেড নাই। দুই ম্যাগাজিন গুলি আছে। বাবায় কাভার দিবো।

তাইলে মেইন ফাইটার আমরা দুইজন?

না, আমরা সবতেই! সবার সামনে থেকে মমতার কণ্ঠ ভেসে আসে।

আরো কিছুদূর চলার পর দলটি কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। সবার সামনে থাকার কথা আলিম বক্সের। কিন্তু সেখানে দেখা যায় হোসেন মৃধা আর চান্দভানু। তারপর হাসন আলি, জুলেখা আর মমতা। সবার শেষে আলিম।

হঠাৎ হোসেন মৃধা ঘোষনা করলো, আমরা আগে মতি ভাইয়ের বাইত্যে উঠমু পিছনের জঙলা দিয়া।

না। তখনই অমত প্রকাশ করে চান্দভানু। বলে, আমরা উঠমু মায়ের ঘরের পিছন দিয়া। ওইদিগে কেউ যায় না।

আলিম বক্স দলের কমান্ডার হলেও অবস্থা দৃষ্টে মূল নেতৃত্ব চলে যায় হোসেন মৃধা আর চান্দভানুর হাতে। বুঝে শুনেই চুপ থাকে আলিম। যেহেতু চান্দভানুর বাপের বাড়ি সিদ্ধেশ্বরী। নিজের গ্রাম। এ ক্ষেত্রে তারাই পথঘাট ভালো বুঝবে।

দলটি আধো অন্ধকারে মতিউর রহমানের বাড়িতে উঠতেই হোসেন মৃধা আর চান্দভানু উঠোনের মাঝামাঝি পিতলের বদনি হাতে দাঁড়ানো মতিউর রহমানের মুখোমুখি পড়ে যায়।

কেরে? কেরে তরা? বলতে বলতে আতঙ্কিত মতিউর রহমান তাদের উপর টর্চের আলো ফেলে। আর চান্দভানু ও হোসেন মৃধাকে চিনতে পেরে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো, তরা এত রাইতে?

নিজের মুখে আলো পড়তে দেরি হতে পারে হয়তো কিন্তু কর্তব্য স্থির করতে দেরি হয় না চান্দভানুর। সে এগিয়ে গিয়ে টর্চ ধরা হাতটা সহ ধরে মতিউর রহমানকে অন্ধকারের দিকে টানতে টানতে বলে ওঠে, মিয়া ভাই, আপনের অনেক বিপদ! হুনছি মুক্তিরা আইতাছে! আপনে পলান!

কি কস তুই? যেন বিশ্বাস হয় না তার। তাই হয়তো বলতে পারে, বেশরমের মতন নাসারাগো লেবাস পিনছস কী বুইঝ্যা?

অহন অত কথা কওনের সময় নাই! বলেই, সে হোসেন মৃধাকে বললো, ধরেন না ক্যান?

তখনই বাকি পাঁচজন যার যার গলায় ঝুলিয়ে রাখা রশি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মতিউর রহমানের উপর।

মতিউর রহমান উঠোনের মাটিতে চিৎ হয়ে পড়তে পড়তে একবার শুধু চিৎকার করে বলতে পারলো, আমারে মাইরা ফালাইলো রে!

এর পরই আলিম বক্স মতিউর রহমানের কাঁধের আরবি রুমালটা মুঠোতে ধরে মুখে ঠেসে ধরে।

কাজটা বেশ নির্বিঘ্নেই সারতে পারে ওরা। মতিউর রহমানের দুই স্ত্রীর কেউ বেরিয়ে এলো না। এলো না কোনো পড়শীও। বাড়িটা যেন নিঝুম পুরী।

মতিউর রহমানের হাত-পা আর মুখ বেঁধে বাড়ির ময়লা ফেলার ঢালু জায়গাটিতে সবাই মিলে ধরাধরি করে নিয় যায়। হাসন আলি মতিউর রহমানের মাথায় রাইফেল তাক করলে, আলিম বক্স সেটা ধরে বললো, গুলি করন যাইবো না ভুইল্যা গেলি?

তাইলে এই রাজাকারডারে নিয়া কি করমু?

পরে দেহা যাইবো বাজান! চান্দভানু সরব হয়ে ওঠে। অহন খুন-খারপি কইরা আসল কাম নষ্ট করার কাম নাই! আমগো যাইতে হইবো ইস্কুল ঘরের দিক।

আলিম বক্স এবার বুঝতে পারে, দলে নারী সদস্য আসাতে কেন রুষ্ট হয়েছিলেন হাবিলদার। এখন চান্দভানুকে এড়িয়ে বা উপেক্ষা করে মতিউর রহমান সম্পর্কে যে নির্দেশ ছিলো তা আর পালন করা হবে না। যে কারণে আরো বড় ক্ষতির সম্মূখীন হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে পুরোপুরি।

দলটি মতিউর রহমানের বাড়ি থেকে বেরোবার মুখেই হোসেন মৃধার কানে অকস্মাৎ ধ্বণিত হয় বিগত এক রাতের নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকার। তখনই হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

বাজান থামলা ক্যান? হাসন আলি খানিকটা অবাক হয়েই শুধায় যেন।

হোসেন মৃধা পেটের উপর হাত রেখে বললো, তরা আগায় যা, প্যাটটা কেমুন জানি চিপ মারছে!

চান্দভানু কেমন রুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো, আপনের সময়-গময় আর ঠিক হইলো না!

তরা যা! বলেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় হোসেন মৃধা।

সে তেমন একটা সময় নেয় না। নিজের রশিটি দিয়ে বন্দী মতিউর রহমানের গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাশের একটি গাছের সঙ্গে টানটান করে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর খানিকটা দৌঁড়েই সে যোগ দেয় এগিয়ে যাওয়া নিজের দলটির পেছনে।

(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১৪

You must be logged in to post a comment Login