ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৯
মজিবর মাস্টার হোসেন মৃধার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার দিন তিনেক পর অন্ধকারে কাদা পানি ভেঙে হরি ঘোষ এসে দেখতে পায় হোসেন মৃধার ভিটা থাকলেও সেখানে ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। একটু ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হরি ঘোষ ভাবছিলো যে, যদি মতিউর রহমান অথবা কানা আজমের দল ঘর দুটো পুড়িয়ে দিয়ে থাকে চালের টিনগুলো অন্তত থাকার কথা। টিনগুলোও কি পুড়ে গেছে? হোসেন মৃধার আর তার পরিবারের বিপদ হওয়া মানে তো মমতারও বিপদ। আর এ কথা মনে হতেই তার মাথার ভেতরটা অকস্মাৎ কেমন দুলে ওঠে।
সঙ্গে সঙ্গে নিজকে সামলাতে সে বসে পড়ে মাটির ওপর। বেতের জঙ্গলে পাহারায় ছিলো জুলেখা। সে তাদের পোড়া ভিটে দুটোর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ঠিক তখনই কোনো মানুষের নড়াচড়ার আভাস পেয়ে সে আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মনে হলো কেউ যেন মাটিতে বসলো। তখনই সে আজমের কোনো সঙ্গী সন্দেহ করে জঙ্গলের গভীরে ছুটে গিয়ে হোসেন মৃধাকে ব্যাপারটা জানালে একে একে সবাই মিলে ফের আড়াল থেকে দেখতে চেষ্টা করে। অন্ধকারে মাটির ওপর বসে থাকা মানুষের আকৃতিটি দেখতে পেয়েই মমতা অস্ফুটে বললো, বাবার মতনিত্তো লাগে!
হোসেন মৃধা তেমনই নিচু কণ্ঠে বললো, আগে ভালা মতন দেইখ্যা লই!
হোসেন মৃধার কথা শেষ হয় কি হয় না, ঠিক তখনই হরি ঘোষের মুখে টর্চের আলো পড়ে। টর্চের পেছনে কানা আজমের কণ্ঠ করকর করে বেজে ওঠে যেন, এহানে বইয়া করস কি? বিভ্রান্ত হরি ঘোষ বলে ওঠে, কিছু না!
নাকি মিরধারে তার পোলার খবর দিতে আইছস? না। মিরধার কাছে আইছিলাম। আর আইয়াইত্তো দেহি সব পুইড়া গেছে! মিরধার কাছে আইলে এত রাইতে কি? অই মালাউনের বাচ্চা মালাউন! হাচা কইরা ক, দিনের বেলা না আইয়া রাইতে আইছস ক্যান? তারপরই সে হরি ঘোষকে বুট পরা পায়ে লাথি দিলে অথবা বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করলে হরি ঘোষ আর্তনাদ করে হয়তো মাটিতেই লুটিয়ে পড়ে। এরপর আরো আঘাত করে হয়তো।
হরি ঘোষের মুহুর্মুহু আর্তনাদে মমতার হৃদপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয়ে আসে। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলেও কোনো শব্দ করে না সে। তার এই স্থিরতা ছিলো পলকের জন্যেই হয়তো। তারপরই সে ঘুরে যেখানে জংলার সাথে কোচ আর ট্যাটাগুলোকে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে, সেদিকেই ছুটে যায়। একমাত্র কোচটি হাতে নিয়ে ফিরে আসলে চান্দভানু আর হোসেন মৃধা তার পথ রোধ করে। হোসেন মৃধা বললো, একলা পারবি না! আমরাও যামু! তয় সাবধানে। আগে দেইখ্যা লই তারা কতজন?
অন্ধকারে তেমন ঠাহর করা যায় না। তবুও তাদের কণ্ঠস্বরে আবছা মত অনুমান করা যায় যে, কানা আজমের সঙ্গে আরো দুজন থাকতে পারে। দ্বিতীয় একটি কণ্ঠ বলে উঠলো, হালারে গুল্লি দে! আজম বলে, অহনতরি গুল্লি পাইনাই! আর তা শুনে তৃতীয় আরেকটি কণ্ঠ বলে উঠলো, হালার ভাই হালা, তুমি খাইল্যা বন্দুক দিয়াই এত বড় ভাব লইতাছ?
দেলোয়ার কারি কইছে, কাইলকা গুল্লির ব্যবস্থা কইরা দিবো। বন্দুক চালাইতে পরবি তো?
তখনই তাদের হাসির শব্দ ভেসে আসে। হোসেন মৃধা দৃঢ় কণ্ঠে জানায়, তিনজন! আর দেরি না! বলেই হোসেন মৃধা কাঠের হাতলঅলা শাবলটি তুলে নিতেই জুলেখা ট্যাটা আর চান্দভানু দুহাতে দা আর পাট কাটার কাটারী নিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বের হওয়ার জন্য পরিষ্কার করে কেটে দরজার মত বাইনয়ে রাখা জায়গাটার দিকে এগোয়। আর তখনই ঠিক জঙ্গলটির উপরই টর্চের আলো পড়ে। আলোটা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। তারপর লম্বালম্বি এদিক ওদিক আসা যাওয়া করে। জঙ্গলের ভেতরকার চারজনের দলটি কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে।
আলোটা নিভে গেলে, হোসেন মৃধা ফিসফিস করে বললো, মমতা একজনের বুক নাইলে প্যাট চাইয়া কোচ বসাইবা। আমি শাবল দিয়া একজনরে মারমু। জুলেখা আর চান মিল্যা আরেকজনরে ধরবি!
অতি সন্তর্পনে দলটা বেরিয়ে আসার পর ঠিক আক্রমণের সময় পিতার আর্তনাদে হাত কেঁপে যায় মমতার। যে কারণে তার কোচ ঠিকমত আঘাত হানতে পারে না। তার লক্ষ্য কানা আজম থাকলেও সে হয়তো ততটা গুরুতর আহত হয় না। মমতার হাত থকে ফসকে যাওয়া কোচ মাটিতে পড়ে গেলে কানা আজমকে আঘাত করার কথা ভাবে হোসেন মৃধা। কিন্তু সামনেই একজনকে দেখতে পেয়ে সে তার পেট বরাবরই শাবল চালাতে পারলেও সেটাকে তখনই বের করে আনতে পারে না। জুলেখা আর চান্দভানু তৃতীয় জনকে কুপিয়ে আর ট্যাটার আঘাতে মাটিতে ফেলে দিতে পারলেও আজমকে দেখা যায় অন্ধকারেই ছুটে যেতে। এ অবসরে মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে টর্চ খোঁজে হোসেন মৃধা। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে যায় বলে, টর্চ জ্বেলেও কানা আজমকে দেখা যায় না। চারজনে মিলে বেশ কিছুটা পথ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কানা আজমকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসে।
হরি ঘোষ তাদের দেখতে পেয়েই হয়তো নিজেই উঠে দাঁড়ায়। মমতা এগিয়ে গিয়ে বলে, বাবা, তোমার বেশি লাগছে কোনোখানে?
হরি ঘোষ জবাব দেবার বদলে মমতাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠে। সেই সঙ্গ কাঁদে মমতাও।
হোসেন মৃধা খানিক অপেক্ষা করে বললো, অখন কান্দনের সময় না। লাশ দুইটারে লুকাইতে হইবো।
কানা যদি হাঁটাচলা করতে পারে তাইলে মিলিটারি লগে নিয়া আইবো কোনো ভুল নাই!
হরি ঘোষ অকস্মাৎ কান্না থামিয়ে মমতার একটি হাত ধরে বলে উঠলো, মাগো, চল, এই গ্যারাম ছাইড়া আরো দূরের কোনো গ্যারামে যাইগা!
মমতা বললো, কোন গ্যারামে যামু?
হরি ঘোষ হয়তো মনেমনে কোনো নিরাপদ গ্রামের সন্ধান করে চলে।
হোসেন মৃধার সাহস হয় না ফের বেতের ঝোপে গিয়ে আশ্রয় নিতে। অস্ত্র, চিড়া-গুড় আর পানির কলস নিয়ে সবাইকে বললো জঙ্গলটির পেছনে আশ্রয় নিতে। তারপর হরিঘোষকে বললো, কই যাইবা ঠিক করছো?
হরি ঘোষ কোনো জবাব না দিয়ে মমতার হাত আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনই মমতা বলে, বাবা, আগে এই রাইতটা পার করি! তারবাদে যাওন যাইবো।
আহত বাঘ সাধারণ বাঘের চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হয় বলে, কানা আজম এখন আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে।
(চলবে)
9 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৯
You must be logged in to post a comment Login