জুলিয়ান সিদ্দিকী

নিদালি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

রাতটা কোনোরকমে কাটলেও যেন ভোর হতে চায় না সহজে। ঘরের মেটে মেঝেতে বিছানো খেজুরের চাটাইতে পড়ে থেকে এপাশ ওপাশ করাই সার। তবুও চোখ বুজে থাকতে চেষ্টা করে রহিমা। শরীরের ব্যথায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি পুরো রাত। পাশে নাক আর মুখের বিচিত্র অথচ বিরক্তিকর শব্দের ওঠা-নামার মাঝে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আকবর। রহিমার স্বামী বলে কথিত স্বার্থপর মানুষটা। পরিবার আর সমাজ মিলে হাত-পা বেঁধে জলতে ছুঁড়ে ফেলার মত যার পায়ের নিচে ফেলে দিয়েছে নিরন্তর দলিত হওয়ার জন্যে। আর সেই অধিকারের জোরেই যেন নিত্যদিন শরীর-মনের বীজতলার কোমল অংশগুলোতে হাঁসের মত তার নিষ্ঠুরতার ঠোঁটে চরচরানো অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। বাবা-মা জেনেও রা করে না। পড়শিরা দেখেও জোর প্রতিবাদ করতে পারে না। বউ যে ঘরের আসবাবের মতই অস্থাবর সম্পত্তি।

নারী হয়ে জন্মেছে বলে কি সবই মুখ বুজে সইতে হবে তাকে? পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে তার ইচ্ছের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে মানবীর যাবতীয় স্বত্বা? হায়রে পুরুষ! সে যখন অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দিকে ফিরে অসহায় আকুতি জানিয়েছিল, ছেলেকে নিবৃত করার বদলে বরং উসকে দিয়েছে আরও। ষাঁড়ের নাড়াইয়ে দু পক্ষের জন্তুগুলোকে আরও তেজী আর মরিয়া করে তুলতে আশপাশের লোকজন যেমন নানাবিধ দুর্বোধ্য শব্দ করে, তেমনি ওরা বউয়ের প্রতি খেপিয়ে তুলেছে ছেলেকে। অথচ মধ্যরাতে কোনো রকম অনুশোচনা ছাড়াই উপগত হয়েছে লোকটি। একবার অনুতাপ না, কোনো রকম ইতস্তত ভাব বা সামান্যতম সমবেদনা প্রকাশের কথাও হয়তো ভাবেনি লোকটি। অথচ নারী হয়ে জন্মাবার অপরাধেই কিনা লোকটি তার মনের কোনো সংবাদ কিংবা সুবিধা অসুবিধা অন্বেষণের প্রয়োজন বোধ করে না। কৈশোরে এমন জীবনের কথা কখনো কল্পনাও করেনি। এমনকি যৌবনের প্রারম্ভে তার ভাবনাতে এতটা গ্লানিকর পরিণতির কথাও উদয় হয়নি কখনো। ঘুণাক্ষরেও মন একবার জানান দেয়নি যে, ভিন্ন একটি ঘরে সম্পূর্ণ অচেনা কোনো একজনের ইচ্ছের কাছেই সমর্পিত থাকতে হবে বাকি জীবন।

এত কষ্টের ভেতরও তার চোখ দিয়ে শিশির পরিমাণ জল বের হয় না। কান্না করাটা যেন তার নারীত্বেরই আরেক অবমাননাকর পরিণতি। যে কারণে বুকের ভেতরটা দিনরাত চৈত্রের দুপুরের মত হুহু করলেও কোনো আক্রোশ কাজ করে না মনের ভেতর। কেবল একটিই ভয়, যে পবিত্র প্রাণটি দিনরাত মিলিয়ে তার জঠরে কয়েকবার নড়েচড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, হয়তো তাকে বহনকারী শরীরটির নানা ধরনের তরঙ্গমালায় নিঃশব্দে জানিয়ে দিতে চায়- মা, আর যাই করস, আমারে মাইরা ফালাইস না! আর এ কথা মনে হলেই রহিমার যাবতীয় কষ্ট লীন হয়ে যেতে থাকে। তখন তার ভাবনায় অনাগত শিশুটির নিরাপত্তাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের বেঁচে থাকার বিষয়টি। সে নিজে না বাঁচলে যে শিশুটির দেখা হবে না পৃথিবীর আলো।

দিন-কতক আগে দিন-মজুর বাবার কাছ থেকে দু-শ টাকা এনে লোকটির হাতে তুলে দেওয়ার পর কিছুদিন নিরুপদ্রব ছিলও রহিমা। কিন্তু শকুনটি বলে দিয়েছে এবার দশ হাজার টাকা দিতে না পারলে প্রাণেই মেরে ফেলবে। আর আকবরের কথাটির বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করেনি সে। এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ই যেন পাথর দিয়ে তৈরি। একটি শৃগালিনী যেমন গৃহস্থের খোঁয়াড়ের হাঁস-মুরগি মেরে নিয়ে আসে নিজের বাচ্চাদের খাওয়াবে বলে। এরাও যেন সেই শৃগালিনী জননী, যারা কেবল নিজের সন্তানের জন্যেই মমতা অনুভব করে। তাদের ঘরের বউটিও যে আর কারো মমতার নিধি সে কথাই যেন তারা ভুলে গেছে।

ভোরের আলো আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠার অপেক্ষা করে না রহিমা। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ঘিনঘিনে লোকটির পাশ থেকে যতটা তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া যায় আর যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। পুরুষের পাঁজরের হাড়ই যদি হয়ে থাকবে স্ত্রীর উৎস তাহলে সেই স্ত্রীর প্রতি পুরুষের আচরণ বৈরী হবে কেন? না কখনো এমনটি হওয়া উচিৎ? এমন দ্বিমুখী কথাবার্তা কী করে যুগের পর যুগ ধরে সমাজ আর পরিবারে টিকে থাকে তাই বোধগম্য হয় না রহিমার। সে আলগোছে শোয়া থেকে উঠে পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। কাক ভোরের মিহি হাওয়া যেন খানিকটা আদরের পরশ বুলিয়ে দেয় তার বেদনাহত দেহে। আর তখনই পেটের ভেতর নড়েচড়ে ওঠে শিশুটি।

এক হাতে আলতো করে নারীর অহংকার নিজের গর্ভ-স্ফীত পেটটিতে চাপ দিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করে শিশুটির নড়াচড়া। স্ফীত পেটের মসৃণ আর টানটান চামড়ার উপর দিয়েই হয়তো অনুভূত হয় শিশুটির হাঁটু অথবা কনুইয়ের অবস্থান। যদিও দিনরাত আপন শরীরেই তাকে বয়ে বেড়াচ্ছে রহিমা, তবুও এতটুকু পরশই যেন অভূতপূর্ব স্বর্গীয় আবেশে বিবশ করে দেয় তাকে। সেই স্বর্গীয় বোধের কল্যাণেই হয়তো বা সে ক্ষণকালের জন্যে অকস্মাৎ বিস্মৃত হয় তার পারিপার্শ্বিক নিষ্ঠুরতাকে। আর সেই মুহূর্তে এক টুকরো মিহি হাসি ফুটে ওঠে তার ফ্যাঁকাসে ঠোঁট জুড়ে। অদৃশ্য অথচ বিদ্যমান সেই শিশু-প্রাণটির সঙ্গে অস্ফুটে কথাও বলে দু-একটা। যেন তাকে আগাম নিরাপত্তার আভাস দিতেই বলে, বাবা, আর কয়ডা দিন!

গর্ভ-স্থিত শিশুটি কি অনুভব করতে পারে জননীর হৃদয়ের আকুতি? হয়তো ব্যাপারটি সে অনুধাবন করতে পারে ঠিকই। আর তাই যেন সে অকস্মাৎ মাতৃ-জঠরের প্রাণরসে পাশ ফিরে শোয় নিশ্চিন্তে। শিশুটির অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথেই রহিমার শরীরও যেন ফিরে পায় পূর্বেকার প্রশান্তি। তার কাছে এখন মনেই হয় না যে, তার পেটটি ফুলে আছে বেঢপ আকারে।

নিয়ম-মাফিক কিংবা বিবাহিত জীবনের অভ্যাসবশতই বাড়ির কাছে দেখতে ডোবার মতো ছোট্ট পুকুরটায় নেমে গিয়ে বুক অবধি জলে দাঁড়ায় রহিমা। ভোরের দিকে পুকুরের জল বেশ নাতিশীতোষ্ণ বোধ হয়। অপার্থিব এক ভালো লাগার তরঙ্গে জলতে ভেসে যেতে চায় সে। আর তখনই বিগত রাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার কষ্টে সৃষ্ট তার মনের ভেতরকার জমাট যন্ত্রণার বরফ খণ্ডটি গলতে গলতে দ্বিগুণ উষ্ণতা নিয়ে দু চোখের কোল বেয়ে নিঃসৃত হতে থাকে। সে কোনো রকম চেষ্টাও করে না নয়নের দু কূল ছাপানো অশ্রুকে বাধা দিতে।

পুরোটা গ্রামের ভেতর এই একটি মাত্র নির্ভরযোগ্য স্থান তার জন্যে। যেখানে নেই কোনো রক্তচক্ষুর শাসন-ত্রাসন। কুটিল মনের সরু দৃষ্টি। এখানেই এই মূক আর বধির জলরাশির পাতা অঞ্জলিতেই সে ঢেলে দেয় তার যাবতীয় দুঃখ-বেদনার পুঁজ-রক্ত। জলে ভাসিয়ে দিয়ে যায় তার বঞ্চনা আর হতাশার গ্লানি। কৈশোর থেকে বোধ-অবোধের ধোঁয়াশায় আড়াল করে রাখা তার অস্পষ্ট স্বপ্নের ঘরটিও।

একটি ডুব দিয়ে উঠতেই পুকুরের জল আর চোখের জল একাকার হয়ে যায় মুখাবয়বে। সুযোগ পেয়ে আরও বেশি করে দু চোখে জল ঝরায় সে। যেন এখনই শুকিয়ে ফেলবে সব অশ্রু। কিন্তু ছোট্ট ডুমুরের মতো মরার দুটো চোখে কতটা পুকুরের জলই না ধরে, জীবনভর কাঁদলেও যা ফুরায় না?

তবুও আপাতত তার কান্না থামে। মনের কষ্ট কিছুটা হলেও যেন হালকা হয়। স্নান সেরে গায়ের কাপড় গায়ে রেখেই নিঙড়ায়ে সে ফিরে আসে ঘরে। এখানে সেখানে সেলাই করা পুরনো শাড়িটা পরে ভেজা শাড়িটা গুটিয়ে নিয়ে ফেলে রেখে আসে পুকুর ঘাটে পেতে রাখা গাছের গুঁড়িটির উপরাংশে। সকালের দিকের কাজগুলো শেষ করে পরে এসে ধুয়ে দেবে। এমনটি প্রায়ই ঘটে। তার নিজের কোনো কাজের চেয়ে সংসারের কাজকেই প্রাধান্য দিতে বাধ্য সে। অসৎ মানুষেরা যেমন ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, তেমনই তার বাবা-মা আকবরকে ঘুষ দিয়ে তার সংসারে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অবৈতনিক। নামে মাত্র অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় যদিও মিলছে, নড়বড়ে এ চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে হতে হয়েছে যৌন-দাসীও।

রান্নাঘরে ঢুকে চুলোর ভেতর শুকনো খড়কুটো-লতাপাতা দিয়ে আগুন ধরায় রহিমা। কলস থেকে হাঁড়িতে জল নিয়ে চুলোয় বসায়। আলু সেদ্ধ না করলে আজ খাওয়া হবে না হয়তো। ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। আজকাল অদ্ভুত একটি ব্যাপার লক্ষ্য করে খুব অবাক হচ্ছে সে, তার ক্ষুধা লাগলে পেটের ভেতর শিশুটিও যেন অস্থির হয়ে পড়ে। কম-বেশি কিছু একটা খাওয়ার পর ফের শান্ত হয়ে যায়। পেটের শিশু কি মায়ের খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খায়? নাকি ভিন্ন কোনো রহস্য আছে?

চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে দিয়ে রহিমা সূচনা করে আরেকটি অনিশ্চিত আর নিরানন্দময় দিনের। ঠিক তখনই উঠনের প্রান্তে শোনা যায় আকবরের শ্লেশ্মাজড়িত কণ্ঠস্বর, তুই আবার পাকঘরে হান্দাইলি ক্যান? তরে না কইলাম বাপের বাইত্যে যাইবার!

আকবরের সমানে কণ্ঠের পর্দা না চড়ালেও রহিমা নিশ্চুপ থাকতে পারে না। বলে, হেঁহ! আমার বাপের বাইত্যে না কত্ত বড় জমিদারি!

রহিমা কি বলে তা আকবরের কর্ণগোচর না হলেও রান্নাঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলে, কি কইলাম, কানে গেছে?

ভেতরে ভেতরে চাপা পড়া বিগত দিনগুলোর ক্রোধ যেন ফেনিয়ে ওঠে তার কণ্ঠে। খানিকটা চড়া স্বরে সে হলে ওঠে, মুখ দিয়া বাইর করলেই অইলো? আমার বাপের কি ট্যাকার গাছ আছে যে কইলেই পাইড়া দিবো?

আকবর সক্রোধে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। রহিমার ভেজা চুল মুঠো করে ধরে তার মাথাটাকে প্রায় ঠেসে ধরে চুলোর মুখে। বলে, তরে বিয়া দেওনের সময় এই কথা মনে আছিলো না তর বাপের যে, কই থাইক্যা দশ হাজার ট্যাকা দিবো?

সে অবস্থাতেই রহিমা কিছু বলতে চাইলো। হয়তো বললও। কিন্তু আকবর তার চুল ধরে এমনভাবেই ঝাঁকাচ্ছিল যে, কিছু বললেও সেই কথাগুলো কম্পিত আর দুর্বোধ্য শব্দমালা হয়ে জ্বলন্ত চুলোর আশপাশেই হারিয়ে গেল যেন। আকবর অকস্মাৎ রহিমার পিঠের ওপর পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করলে সে উবু হয়ে পড়ে জ্বলন্ত চুলার দিকে। সে অবস্থাতেই চুলের গোছা ধরে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে তাকে বাইরে বের করে আনে আকবর। সেই সঙ্গে ক্রমাগত লাথি-উষ্ঠা মারতে মারতে উঠোনে এনে ফেলে। আর এভাবেই বুঝি উঠোনের মৃত্তিকার সঙ্গে সখ্য হয়ে যায় রহিমার। যেন কান পেতে একাগ্র মনে শুনতে চাচ্ছে মাটির একান্ত গোপন কথাটি।

উঠোনের পাশেই ছিলও শিম বা লাউয়ের পুরনো মাচা। সেখান থেকে একটি বাঁশের টুকরো তুলে আনে আকবর। তারপর ভূপাতিত রহিমাকে সেই বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটাতে আরম্ভ করে প্রবল আক্রোশে।

রহিমা সেই আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করতে কোনো চেষ্টাই করেনি তা হয়তো বলা সঙ্গত হবে না। তবে তার চেষ্টা ছিলও পেটে যেন কোনোরকম আঘাত না লাগে। গর্ভের সন্তানকে নিরাপদ রাখতে হাত-পা গুটিয়ে কচ্ছপের মতই উবু হয়ে পড়েছিলো উঠোনের মাঝে। পিঠের ওপর কতশত আঘাত এসে পড়লো সেই বোধ তার ছিলও না। তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে কেবল একটিই বোধ কাজ করছিলো যে, শিশুটিকে রক্ষা করতে হবে আগে! আর এ ভাবনা থেকেই হয়তো সে কোনোরকমে উঠে পড়ে ছুটে যায় বাড়ির বাইরে। কোনোক্রমে যদি সে এ যাত্রা বপের বাড়ি গিয়ে উঠতে পারে, তো এই জীবনে স্বামী বলে কথিত আকবর নামের কুৎসিত প্রাণীটির মুখোমুখি হবে না।

পেছন থেকে তার শাশুড়ির চিৎকার ভেসে আসে, আরে ধইরা আন! গেলে গা তো ট্যাকাও যাইবও!

বাড়ি থেকে এক দৌড়ে ছুটে গিয়েছিলো ঠিকই। পাশের গ্রামে যাওয়ার কাঁচা রাস্তায় উঠেও পড়েছিলো। এ রাস্তাট ধরে বরাবর ছুটে গেলেই তার বাপের বাড়ি। কিন্তু তার পা যে চলতে চায় না। ছুটতে গেলে কেমন পায়ে পা জড়িয়ে আসে। রাস্তায় চলাচল করা কয়েকজন অচেনা পুরুষ দেখতে পেয়ে আপনিই যেন থেমে যায় তার পা। জন্মের পর যে কন্যা শিশুটি পরিবার থেকে শিক্ষা পায় যে, মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করলে গুনাহ হয়। বেপর্দা চললে মরার পর দোযখে যেতে হয়। খোলা চুলে পথ চললে কবরে সেই চুল সাপ হয়ে দংশন করবে। শিশু মন তাই বিশ্বাস করে অবলীলায়। নানারকম শঙ্কার ভেতর দিয়ে বড় হয়ে ওঠার কারণে পরিণত বয়সে সে জড়তায় বন্দী হয়ে পড়ে। ভুলে যায় কিভাবে দৌড়ুতে হয়, মাথা উঁচু করে কিভাবে নাক বরাবর দৃষ্টি রেখে পথ চলতে হয়। পাখা থাকলেই সব পাখি যেমন উড়তে পারে না, তেমনই পা থাকলেও সবাই দৌড়ুতে পারে না। আমাদের মেয়েদের পা দুটো শক্ত হোক এ যেন বাবা-মা হয়েই আমরা চাই না। চেষ্টা করি না।

মানুষের লোভ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, বঞ্চনার আতঙ্ক যখন তাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তোলে তখন তার মনে উদয় হয় না পরিণতির কথা। আর তাই হয়তো আকবর তার মায়ের কথায় ছুটে যায় রহিমার পিছুপিছু। টেনে ছেঁচড়ে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে তৎপর হয় মেয়েমানুষের বাড়াবাড়িকে কমাতে। রহিমার ওপর যাবতীয় ক্রোধ ঢেলে দিয়ে আকবর যখন শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে হাতের বাঁশটি ফেলে দিয়ে পরিতৃপ্তি আর বীরত্বের শ্বাস ফেলে পুনরায় তাকাল ভূলুণ্ঠিতা নগদের পণ-বন্দিনীর দিকে, সেখানে তেমন কোনো স্পন্দনের উপস্থিতি দেখতে না পেয়ে খানিকটা শঙ্কিত হয়ে তাকায় মায়ের দিকে। মা তাকে অভয় দিতেই যেন বলে ওঠেন, মাইয়া মানষ্যের জান হকুনের চাইয়াও বড়!

যতই নিরাপত্তা থাকুক অপরাধীর অনুশোচনা আসবেই। তার চোখেও একদিন পতিত হবে মনুষ্যত্বের আলো। এমনটি না হয়ে পারে না। নয়তো প্রকৃতি বিলীন হয়ে যেতো কবেই। মায়ের অভয় বাণীতে শঙ্কা দূর হয় না আকবরের। মরমর প্রায় রহিমার দিকে তাকিয়ে তার অন্তরাত্মা যেন কেঁপে ওঠে। হায় হায়! আমার বাইত্যে মরলে তো জেল-ফাঁসি না হইয়া উপায় নাই! তারপরই সে আর্তনাদ করে ওঠে, কে আছসরে আমার লগে আয় এইডারে হাসপাতালে নিয়া যাই!

এদের কাছে রহিমা এবং তার গর্ভজাত সন্তানের প্রাণের চেয়ে নিজেদের আইনগত নিরাপত্তার বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। তাই তারা তৎপর হয় বাড়ি থেকে রহিমাকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সে সময় তার চেতনায় কাজ করে চলেছে অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়টি। যে কারণে শিশুটির সঙ্গে আনমনে সে কথা বলে। হাসে। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নিয়ে খেলা করে। দোলনায় শুইয়ে দোলায়। সঙ্গে সঙ্গে দোলে সে নিজেও।

আসলে তখন সে তার স্বামী আর দেবরের মাঝখানে রিকশা-ভ্যানে শুয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে। কিন্তু এবরো-থেবড়ো পথে চলমান রিকশা ভ্যানের ক্রমাগত দুলুনি পুনঃ বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে পারে না তার অর্ধ-চেতন দেহকে। বোধ-অবোধের দোলাচলে ক্রমশ লীন হয়ে যেতে থাকে সে। যেন চরম ক্লান্তি অথবা প্রচণ্ড রকমের একটি ঘুমঘুম ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ধীরে ধীরে।

____________

(ছবিটি গুগোলের সাহায্যে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


20 Responses to নিদালি

You must be logged in to post a comment Login