নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত -১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

(সুপ্রিয় পাঠিকা এবং পাঠকবৃন্দ,

আজ একটা নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করলাম। তাই বলে ভাববেন না যে নক্ষত্রের গোধূলি শেষ । নক্ষত্রের গোধূলি শেষ হতে অনেক দূর। নির্বাক বসন্ত কেমন লাগছে জানাতে ভুল করবেন না। আপনাদের মতামতের উপর লেখকের অনেক কিছু নির্ভর করে।)

[প্রথম অধ্যায়]
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই জাহিদের মনটা কেন যেন বেশ একটা চক চকে ঝরঝরে ফুরফুরে ভাব, খুশি খুশি। কিন্তু, কি যে সে কারন তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। বাইরে যাবে, নিজের খেয়াল মত ঘুরবে, বেড়াবে এই জন্য না কি বিশেষ কারো কথা মনে পরেছে?যাই হোক, সে কারন খোঁজার কি এমন প্রয়োজন?মন ভালো আছে, ভালো লাগছে এইতো বেশ, আর কি?এই বিদেশে, মরুভূমির দেশে সাগরে ভেসে থেকে এর চেয়ে আর কি চাইতে পারে?এই যথেষ্ঠ। সকালের টুকিটাকি কিছু কাজ ছিল, সেগুলি সেরে চিফ অফিসারকে বলে জাহাজ থেকে নেমে গেল। আজ তার শোর লিভ, মানে, আজ তার ছুটি। সাগর ছেড়ে মাটিতে চলার অনুমতি। নোনা জলের সাগর ছেড়ে সে আজ সারা দিন মাটির উপর ঘুরে বেড়াবে। এরা বিয়ান গলফের ছোট্ট দ্বীপ বাহরাইনের মানামা শহর। এখানে তার বৃটিশ পতাকাবাহী ‘প্যাসিফিক মেরিনার্স’ তেল বাহি ট্যাঙ্কার জাহাজ রুটিন মেইনটেন্যান্স এর জন্য এসেছে।

তিন দিন থাকবে, তারপর আবার চলে যাবে এ বন্দর ছেড়ে ও বন্দরে। ওরা কোন বন্দরে লোড বা আনলোড করার জন্য এক দিনের বেশি সময় পায় না, কোথাও আবার সাগর পাড় থেকে পাচ দশ মাইল দূর থেকেই লোড আনলোড করে চলে যেতে হয়, তখন দূরের শহরের বাতি নয়তো প্রায় আকাশের কাছে পৌছে যাওয়া দালান গুলি দেখে স্বপ্নের কোন দেশের মত মনে হয়। আজ জাহিদের মনে খুবই আনন্দ। সাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ শহরে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়াবে। কখনো বাসে চেপে, কখনো ট্যাক্সিতে কিংবা পায়ে হেটে।

সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় সাদা ফেনার লুকোচুরি জাহিদের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়, কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আজ একটু ভিন্ন রকম। সাগর ছেড়ে সে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। মাটির গন্ধ, মাটির ছোয়া পাবার জন্য।
জাহাজ থেকে নেমে হেটে ডকের বাইরে এসে পাশের স্টোর থেকে এক ক্যান জিঞ্জার এল কিনে মুখটা খুলে এক চুমুক দিয়ে ক্যান হাতে পাশের বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো।

হঠাত্ মন পরিবর্তন করল। না আজ কোন বাস ট্যাক্সি নয়, আজ শুধু হাঁটবে। হাটতে হাটতে চলে এলো মানামা শহরে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত এলো চেনা পাকিস্তানি সিঙ্গারার দোকানে। এখানে ১০০ ফিলসে কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে চাটনি। সাধারন আলুর সিঙ্গারা কিন্তু কি ভাবে বানায় কে জানে, ভীষন মজা। আর তার সাথের চাটনি টা আরো বেশি মজার। বিশেষ করে এই চাটনির লোভ টাই বেশি। বাহরাইনে এলেই এই সিঙ্গারা তার চাই, নিজে যেতে না পারলেও যেই যাক তাকেই বলে দেয় আমার জন্য সিঙ্গারা এন। আরো একটু চাটনি চেয়ে নিলো। দোকানে কোন বসার জায়গা নেই, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে খেতে হয়, কোন পানিও নেই। আলাদা করে পানি বা সফট ড্রিঙ্কস যার যা পছন্দ তা কিনে নেয়, এ জন্য আলাদা ৫০ ফিলস। তার হাতে এখনো সেই জিঞ্জার এলের ক্যান রয়েছে। ক্যানটা দোকানের কাউন্টার টেবিলের উপর রেখে এক হাতে প্লেট ধরে আর এক হাতে খাচ্ছিল। সিঙ্গারা শেষ হলে হাতের খালি প্লেট বিনে ফেলে দিয়ে শেষ চুমুক দিয়ে ক্যানটাও বিনে ফেলে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।

উদ্দেশ্য হীন ভাবে, কোন গন্তব্য নেই। মার্কেটে মানুষ গিজ গিজ করছে। প্রায় সবাই যার যার গাড়ি রেখে এসেছে শহরে ঢোকার আগে ঐ সাগর পাড়ে পার্কিং এলাকায়। কেউ জোড়ায় জোড়ায়, কেউ তার মত একা। শিশু, কিশোর, তরুণ তরুনী যুবক বৃদ্ধ, কালো, ককেশিয়ান, সাদা নানা রকমের নানা রঙের মানুষের ভীড়। আমাদের দেশের ছোট ছোট চায়ের দোকানের মত বাইরে সামিয়ানা টানান রয়েছে তার নিচে বয়ষ্ক লোকেরা টেবিলের চার পাশে বসে বিশাল কলকির হুক্কা টানছে আর গাওয়া খাচ্ছে(এক ধরনের কাল কফির মত), হুক্কার নল এর হাত থেকে ওর হাতে বদল হচ্ছে। কেউ দোকানির সাথে দামাদামি করছে, কেউ কিনছে, আবার তার মত কেউ শুধু দেখছে।

সাজানো দোকান পাট তো রয়েছেই তার পাশে আমাদের দেশের মত ক্যানভাসের চাদর বিছিয়ে খোলা দোকানও আছে। বাচ্চাদের খেলনা, তৈরী পোষাক, ঘর সাজাবার নানা রকমের সৌখিন জিনিসপত্র, পারফিউম, আতর, মশলা রাখার সুন্দর রেকাবি, মোমদানি, নানা রকম কারু কাজ করা ছবির বাধানোর ফ্রেম আরো কত কি। হঠাত্ তার চোখে পরলো এই রকম এক খোলা দোকানের এক দোকানি মিসরিয় কারুকাজ করা ধুপ দানির মত একটা পাত্রে ছোট ছোট কাঠের টুকরোর মত কি যেন জ্বলন্ত কয়লার আগুনে ছেড়ে দিতেই ধোয়ার সাথে ভুর ভুর করে একটা মন মাতানো সুগন্ধ ভেসে এলো ওর নাকে। জাহাজ থেকে নামার সময় স্যেনেল ফাইভ স্প্রে করে এসেছে এ গন্ধ সে গন্ধকেও হার মানানো গন্ধ। মনে কৌতুহল হোল, এটা কি?জিজ্ঞেস করবে কিন্তু জাহিদ আরবি তেমন জানে না, তার ছোট বেলা কেটেছে করাচী শহরে তাই উর্দু ভালোই জানে। তারপর আবার জাহাজে চাকরী করতে এসে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরতে গিয়ে ইংরেজি টাও ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কাজেই, কোথাও তেমন অসুবিধা হয় না। তবুও এগিয়ে গিয়ে আরবি যা জানে তাই আর উর্দু হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো।

ইয়েমেনি দোকানিও সেই ভাবে জবাব দিল কেন, আগে দেখনি, এগুলির নাম হোল আগর বাংলাদেশ থেকে আসে। বিশাল একটা গাছ থেকে মাত্র চার বা পাঁচশ গ্রাম আগর বের হয় বলে খুব দামী জিনিষ। কত দাম? পাচ গ্রামের এই প্যাকেটের দাম দশ দিনার। জাহিদ ভেবে দেখলো যাদের পকেটে এতো দিনার বা ডলার আছে, যাদের পকেটের দিনার বা ডলার দিয়ে ব্যাঙ্ক গুলি চলছে তারা ছাড়া এগুলি আর কে ব্যবহার করবে? তাদের ঘরের স্বপ্নিল আবেশ তৈরীর জন্য কিংবা রাতের মোহ ময়তা বাড়াবার জন্য তারাই এগুলি জ্বালাতে পারে। ওর মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠলো। আমার দেশেও এমন জিনিষ আছে যা আমার জানা ছিল না অথচ এই পেট্রো ডলারের দেশের ধনী লোকেরা তা ব্যবহার করছে।

আতরের খবর জেনে খুশি মনে আবার চলল উইন্ডো শপিং করতে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজ কালের ব্যাস্ত মানুষের জীবন সহজ করার জন্য কি কি আবিষ্কার করেছে, বাজারে কি কি নতুন জিনিষ এসেছে তাই দেখার জন্য। ইলেকট্রনিক্সের দোকান, নানা ধরনের যন্ত্রপাতির দোকান, তৈজস পত্রের দোকান দেখে বেড় হয়ে কাপড়ের দোকানে ঢোকার পথেই মনিরের সাথে দেখা। মনির ওর ক্লাস মেট, নেভিগেশন স্কুলে এক ব্যাচেই ছিল। এখন ও অন্য আর এক জাহাজে আছে, সেও শোর লিভ নিয়ে কেনা কাটা করার জন্য এসেছে।
কিরে জাহিদ, কেমন আছিস?
ভালো, তোর কি খবর, ইস তোকে দেখে হিংসা হচ্ছে রে।
কেন, হিংসা কেন?
ভয়েজ শেষ করে দেশে যাচ্ছিস হিংসা হবে না?
তুইও তো আর কদিন পর যাচ্ছিস।
না, আমার দেরি হবে কারন আমার রিলিভার না এলে আমাকে ছাড়বে না বলেছে, আবার ওদিকে চিটাগাংয়ের এজেন্ট রিলিভার পাচ্ছে না।
যাক আর কিছু দিন থাক, অসুবিধা কি? তোর জন্যে কেউ আর পথ চেয়ে বসে নেই।

যাক বাদ দে ওসব, এখন বল কি করবি?
কিছু কেনা কাটার জন্য এসেছি।
তোরা না কাল দুবাই যাচ্ছিস তাহলে এখান থেকে কিনবি কেন, এখানে তো দাম বেশি।
না, দুবাই পৌঁছবো রাতে আর আমার ফ্লাইট সকালে, টিকেট করে ফেলেছে শুনেছি, তাই ওখানে সময় পাবো না। বেশি কিছু কেনার নেই শুধু ভাবীর জন্য একটা শাড়ি।
ও তাহলে চল।
না তোর সাথে এতো দিন পর দেখা হোল চল আগে কিছু খেয়ে নিই।
কি খাবি, আমি এই মাত্র সিঙ্গাড়া খেয়ে এসেছি।
হ্যা আমিও ভেবেছি তুই বাহরাইন এসেছিস আর এখনো সিঙ্গাড়া খাসনি এ হয় কি করে? তোর সিঙ্গাড়া প্রীতির কথা এই গালফে কে না জানে।
চল তুই খেয়ে নে।
না থাক, ভাবীর শাড়িটা আগে কিনে নেই তার পর দেখবো।
চল ঢুকি এই দোকানই তো।
দুজনে দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজে যেখানে শাড়ি রয়েছে সেখানে গেল। অনেক শাড়ি দেখলো কিন্তু কোনোটাই মনিরের পছন্দ হচ্ছে না।
দেখ জাহিদ এই সব মেয়েলি কেনা কাটা আমার কাজ না, তুই একটা দেখে দে।

বারে, এ আবার কি ধরনের কথা বলছিস, আমি কি তোর ভাবীকে দেখেছি? যাকে দেখিনি তার জন্য কি পোষাক বাছাই করা যায়?
শেষ পর্যন্ত জাহিদকেই একটা বাছাই করে দিতে হোল।
পছন্দ হয়েছে তোর?
হ্যা খুব।
তাহলে দেখ দাম কত। দোকানির সাথে দামাদামি ঠিক হোল। মনির পকেটে হাত দিয়েছে দিনার বের করবে। হঠাত্ পকেট থেকে হাত বেড় করে বললো,
নারে জাহিদ ভাবীর এই শার পছন্দ হবে না, এটা নেয়া যাবে না।
কি হোল, আবার এ সিদ্ধান্ত কেন?
ভাবির নীল রঙ পছন্দ না।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to নির্বাক বসন্ত -১

You must be logged in to post a comment Login