এ.বি.ছিদ্দিক

ফানুস – ১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কারো বিরহের কালো কষ্টের কান্না।কারো জীবন নদীতে ভেসে যাওয়া একটি কদম ফুল।  কখনও জ্যোৎস্না  রাত, সেই রাতে রাত্রি কন্যা ওঠে কখনও বা বিসর্জন যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে একদল মানুষ, কেও হাসে, ভাসে। নতুনকে জায়গা দিয়ে পুরনোরা বিদায় নেয়। রাত পেরিয়ে দিন আসে, তবু যেন আধার ই কাটে না। ঘোর বিরহে কেটে যায় স্বপ্নগুলো। ঘুম ভাঙলে মনে হয় এসব যেন শুধুই  স্বপ্ন। তবু সে স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে চলছে মানুষ, চলবে।

মেজ বোন তরীর ৬ দিনের বাচ্চা নিয়নের ট্যাঁ ট্যাঁ কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দিনের। একগাদা বিরক্তি ও রাগ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর মোবারক হোসেন সাহেবের ছোট পুত্র দিন ফলিত রসায়নের ৩য় বর্ষের ছাত্র। ফলিত রসায়নের ছাত্র হলেও তার বেশিরভাগ সময় ই কাটে মৎস্য শিকারে।

বারান্দায় ইজি চেয়ার চৌকি দুই ব্যবস্থাই আছে। কিন্তু ঠিক কোনটার আশ্রয় নেবে বুঝতে পারছেনা ও। তবে যার আশ্রয়ই নিক না কেন এখান থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ কান্না শোনা যাবে না তাতেই অনেক খুশি দিন। ইজি চেয়ার এ গা টা এলিয়ে দিতেই মোবারক হোসেন সাহেব বারান্দায় প্রবেশ করলেন।

–           আমি ভেবেছিলাম শুধু আমি-ই, তুই ও আছিস দেখছি।

– বাবা, বস।

দিন উঠে দাঁড়াল। বাবা হিসেবে মোবারক হোসেন সাহেবকে সবাই একটু বেশি ভক্তি করে এ বাড়িতে।

–           বস, বস আমি চৌকিতে বসছি।

–           পা তুলে বস আরাম পাবে।

বাধ্য ছেলের মত মোবারক হোসেন সাহেব চৌকিতে পা তুলে বসলেন। বসতে বসতেই তিনি দেখলেন তার ছোট মেয়ে মায়া বালিশ হাতে আপন মনে উনার দিকেই এগিয়ে আসছে। ও কাকে বকছে পাশের কেও যেমন জানে না, ও নিজেও জানে না। অন্য ৫ ছেলেমেয়ের চেয়ে মোবারক হোসেন সাহেবের এই মেয়েটি একটু অন্য রকম। আশ্চর্য রূপ নিয়ে জন্ম নিয়েছে মায়া।এস.এস.সিতে সবকটি বিষয়ে A+ পেয়েছে। সবার ধারণা এইচ.এস.সিতেও ও A+ পাবে। মায়ার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য সে তার মুখে যা আসে, শ্রাব্য, অশ্রাব্য সবই বলে। মায়া এখন কি বলতে বলতে আসছে সেটাই শোনার চেষ্টা করছেন মোবারক সাহেব।

–           দিন নাই রাত নাই ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ, অসহ্য। এখন গিয়ে যদি বালিশটা মুখের মধ্যে গুজে দিতে পারতাম! সেটাই ভাল হত।

মায়া বুলেটের বেগে ঘরে ঢুকল।

–           ও তুমি এখানে? শোন বাবা সব দোষ তোমার, তুমি হচ্ছ গুরু, গুরু অফ দ্য নাট, গুরু অফ দ্য নাট বোঝ? নাটের গুরু ।

–           আমি আবার কি করলাম?

–           তুমি কি করনি? তোমাকে পুলিশে দেয়া উচিৎ।

–           কি করলাম সেটা বলবি তো?

–           অবশ্যই বলব, শুনতে চাইলেও বলব, না চাইলেও বলব।

–           তা শোনা।

–           তুমি একজন সম্মানিত ব্যক্তি কিনা?

–           সম্মানিত ব্যক্তি কিনা সেটা জানিনা তবে অসম্মানিত নই।

–           আচ্ছা বাবা তুমি নাকি শিক্ষক মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মত বড় একটা বিভাগের শিক্ষক তুমি।

–           সেটা কি আমার দোষ?

–           হ্যাঁ সেটাই তোমার দোষ, এই যে ভোলাদা তুই ও তো আছিস দেখছি, তুই ভাল করে শোন।

দিন এতক্ষণ চুপ ছিল, নীরবতা ভঙ্গ করে সে বলল

–           মাই নেম ইজ দিন, ডে এর দিন, সারারাত মা খুব কষ্ট করেছিল। খুব ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছিল ঐ রাতে কিন্তু আমি হয়েছিলাম দিনে এবং ঐ দিন দারুণ ঝকঝকে তকতকে সূর্য উঠেছিল বলে বাবাই আমার নাম রেখেছিল দিন।

–           ঐ একই কথা, আমি তোর আগে হলে তোর নাম ভোলাই রাখতাম। শোন ভোলাদা, বাবা? কোথায় যেন ছিলাম?

–           Ò সব দোষ তোমারÓ, ঐখানটাই।

–           ইয়েস সব দোষ তোমার, ইউ আর দ্য গুরু, গুরু অফ দ্য নাট, নাটের গুরু।

–           না পেঁচিয়ে কি তুই কিছুই বলতে পারিস না? আসল কথাটা কি বলবি?

–           অবশ্যই বলব, তার আগে বল তুমি তো শিক্ষিত মানুষ ঠিক কি না?

–           আগে তো সেটাই জানতাম।

–           এখনও তাই জানবে, কিন্তু প্রফেসর মোঃ মোঃ হো খানের মত মানুষের একটা না, ২টা না, দেড় হালি ছেলেমেয়ে, ভাবা যায়!

মায়ার এ কথায় দিন ধাক্কার মত খেলেও মোবারক হোসেন সাহেব সহজ ভঙ্গিতেই বসে রইলেন। তিনি জানেন তার এই মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কিন্তু তার ছেলেমানুষি ভাবখানা এখনও যায়নি। ক্লাস (x)  এ পড়ার সময় মায়ার মাকে নিয়ে যখন তিনি পালালেন তখন তার ভেতরেও এমন একটা ভাব ছিল। ঝিনাইদহ থেকে মাগুরা, বাসে করে পালাবার সে ক্ষণটি এখনও মনে পড়ে মোবারক হোসেন সাহেবের। তিনি তার স্ত্রী হালিমা বেগমকে যতটা না ভালবাসেন তার থেকে অনেক বেশি ভালবাসেন তার এই মেয়েকে।

মায়া কথা বলেই যাচ্ছে, মোবারক হোসেন সাহেব মেয়ের কথা শুনছেন না, তার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়স মেয়েটার কিন্তু এখনই তার মধ্যে শাসক শাসক ভাব এসে গেছে।

–           আমি শিওর বড় আপার বিয়ে যদি আর এক বছর পর  হত আমাদের আরও একটা ভাই অথবা বোন থাকত, ওর নম্বর হত সেভেন, লাকি সেভেন, বাবা তার নাম নিশ্চিত তুমি লাকি রাখতে, তাই না?

–           আমি রাখতাম কিনা জানিনা, তবে তুই যে লাকি ই রাখতি সেটা বুঝতে পারছি।

–           লাকি রাখতাম নাকি ফাঁকি রাখতাম সে কথার আগে বল তোমার মত প্রফেসর সাহেব——

–           তোর কিঞ্চিত ভুল হচ্ছে, আমি আগে প্রফেসর ছিলাম ৬ মাস হল রিটার্য়মেন্ট হয়েছে।

–           আমার ভুল রাখ, তুমি যে ভুল করেছ তার তুলনায় এ ভুল minim, minim  মানে জান তো?

–           জানি, এক ফোটা।

–           মিনিম মানে জান আর এটা জান না ৬, ৬ টা ছেলে মেয়ে হওয়া ঠিক না। অবশ্য সব দোষ তোমার না, তোমার দোষ তিনটায়, মার তিনটায়। ভোলা দা, এই ভোলা দা—-

–           ও ঘুমিয়ে গেছে।

–           কটা বাজে বাবা?

–           রাত ৩ঃ৩১ মিনিট।

–           অনেক রাত, আমার আবার সকালে প্রাইভেট আছে। বাবা তোমার তো আবার রাতে ঘুম হয়না, তাইনা?

–           হুঁ

–           হুঁ আবার কি? কথা বলাই তোমার পেশা, নাকি চাকরি যাবার সাথে সাথে কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছ?

–           না কমায় নি।

–           তাহলে হুঁ, হ্যাঁ উত্তর দেবে না, বিরক্তি লাগে।

–           আচ্ছা।

–           শোন বাবা, তোমার ঘুম হয় না আমার তো হয়, বাবা পা টা ছড়িয়ে দাও তো।

মোবারক হোসেন সাহেব বাধ্য ছেলের মত পা টা ছড়িয়ে দিলেন। মায়া বালিশ এনেছে কিন্তু ও বালিশে না শুয়ে বাবার কোলে শুয়ে পড়ল।

–           বাবা মাথায় হাত বোলাও তো, আমি ঘুমিয়ে যাব।

মোবারক হোসেন সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন

–           বাবা তুমি জীবনে অনেক অন্যায় করেছ।

–           আবার কি করলাম রে মা?

–           এখন কিছু কর নি, তুমি যখন বিয়ে করেছ তোমার বয়স ১৮, মায়ের ১৪। বাল্যবিবাহ। যে কাজী তোমাদের বিয়ে দিয়েছিল সে ও অন্যায় করেছিল।

–           তোর কি মনে হয় আমি কি অন্যায় করেছি?

–           সত্য বলব নাকি মিথ্যা বলব?

–           দুটোই বল, তবে আগে মিথ্যা টা বল্।

–           অনেক অন্যায় করেছ।

–           এবার সত্য টা বল্।

–           ঠিক ই করেছ। তোমাদের প্রেম কাহিনী শুনতে ভালই লাগে। তোমাদের প্রেম কাহিনীটা বল না বাবা।

মোবারক হোসেন সাহেব নিজেও এই কাহিনী বলতে ভালবাসেন, তার ভাল লাগে রং চং মাখিয়ে নিজের প্রেমের কাহিনী বলতে। মোবারক হোসেন সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন।

–           বাবা দাড়াও পাপনকে ডেকে আনি, ঔ শুনুক।

–           পাপন মোবারক হোসেন সাহেব এর বড় মেয়ে কাজলের একমাত্র ছেলে। ওর বয়স ১১ কিন্তু সার্টিফিকেট বয়স ৯, মায়ার মতে পাপন বড় হলে চোর হবে, বয়স চুরি দিয়ে ওর হাতে খড়ি, এ ছেলে চুরি বিদ্যায় একদিন বিখ্যাত হবে।

– বাবা, পাপন ও ভোলাদার মত ঘুমিয়ে, ঘুমে কুম্ভকর্ণ©, ডেকে ডেকেও লাভ হল না।

মায়া বাবার কোলে আবার শুয়ে পড়ল।

–           বাবা শুরু কর, তোমাদের কাহিনী বলবে আর আমার মাথায় হাত বোলাবে, আমি চোখ বুজে তোমাদের প্রেমের কাহিনী শুনব।

–           মোবারক হোসেন সাহেব তার প্রেমের কাহিনী বলতে শুরু করলেন।

–           শোন তা হলে, আমি তখন নাইন এ পড়ি, তোর মা এইটের ছাত্রী, আমি রোজ সকালে পড়তে যেতাম তোর নানু বাড়ির সামনে দিয়ে, তোর মা তখন বাইরে বের হত সুপারি কুড়োবার নাম করে——

–           শুনছিস মায়া?, মায়া এই মায়া।

মায়া ঘুমিয়ে গেছে, মোবারক হোসেন সাহেব অপলক তাকিয়ে আছেন মেয়ের মুখের দিকে। কে বলবে একটু আগে এই মেয়েটি বাবার সাথে ঝগড়া করছিল?

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to ফানুস – ১

You must be logged in to post a comment Login