এ.বি.ছিদ্দিক

ফানুস-৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কাজলকে বাড়িতে আনা হয়েছে। ও একা আসেনি, ওর দেখাশোনা করার জন্য নার্স রূপকথাকেও আনা হয়েছে। রূপকথা এখানে এক মাস থাকবে। ওর প্রধান কাজ কাজলকে দেখাশোনার পাশাপাশি তরী আর তার বাচ্চা নিয়নকে দেখাশোনা করা। তরীর কাওকে পছন্দ হয়না কিন্তু রূপকথাকে হয়েছে। রূপকথাকে দ্বিতীয় তলার দক্ষিণে তরীর পাশের ফাঁকা ঘরটা দেয়া হয়েছে থাকবার জন্য। মোবারক হোসেন সাহেব বারান্দায় চৌকিতে বসে আছেন। রূপকথা বারান্দায় এলো।

–           স্যার আস্লামালিকুম।

–           ওয়ালাইকুম সালাম, বস মা।

রূপকথা বেশ শান্তভাবে চেয়ারের উপর বসল।

–           তোমার নামটা যেন কি বলছিলে মা?

–           স্যার রূপকথা চট্টোপাধ্যায়।

–           ও আচ্ছা।তোমার নামটা তো খুব সুন্দর।

রূপকথা হাসে কিছু বলেনা।

–  রূপকথা চট্টোপাধ্যায়। তুমি তো তাহলে হিন্দু?

–           জি স্যার।

–           তাহলে তুমি আমায় সালাম না দিয়ে নমস্কার করতে পার আমি কিছু মনে করব না।

–           জি স্যার।

–           আমি কে তুমি কি তা জান?

– হ্যাঁ স্যার জানি। আমাকে হাসপাতাল থেকেই সব বলে দেয়া হয়েছে।

– মানে আমি কি করি আর কি? আমার পেশা কি, সেটা জান?

–           জি স্যার জানি, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বাংলাদেশে বড় বড় যে কয়েকজন শিক্ষক আছেন আপনি তাদের মধ্যে একজন। বাংলাদেশে আপনি ই প্রথম যিনি কিনা ফ্লাইং সসার এবং ইউ.এফ.ও নিয়ে গবেষণা করেছেন।

: হাসপাতাল থেকে এতো তথ্য জানিয়ে দিল?

: না স্যার।

: তাহলে?

:   স্যার আমি যে এতিমখানায় মানুষ হয়েছি আপনি সেখানে একবার বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলে এবং সবাইকে অবাক করে আপনি এতিমখানায় এক লক্ষ টাকা অনুদান করেছিলেন। সেখান থেকেই আমি আপনাকে চিনি।

– ও আচ্ছা।

মোবারক হোসেন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর আবার বলেন।

–           রূপকথা মা?

–           জি স্যার?

–           তোমার মা বাবা কেউ তাহলে বেঁচে নেই?

–           স্যার আমার বাবার সাপে কেটে মিত্যু হয়, আমার মার খবর আমি জানিনা স্যার।

রূপকথা খুব স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলল, মোবারক হোসেন সাহেব রূপকথার দিকে ক্ষাণিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন এবং চোখ নামিয়ে নিতে নিতে বললেন

–           ভেরি স্যাড।

রূপকথা তার উত্তরে কিছু বলল না। মোবারক হোসেন সাহেব কথা ঘোরাবার জন্য বললেন-

– রূপকথা?

–           জি স্যার?

– তোমার বয়স কত মা?

– বাইশ।

– হুম।

মোবারক হোসেন সাহেব ক্ষাণিকক্ষণ থেমে বললেন

– এইটা তো বাসা, এখানে কেও স্যার স্যার করলে কেমন অসস্তি লাগে, নিজেকে শিক্ষক শিক্ষক লাগে। তুমি এক কাজ কর, তুমি আমায় চাচা, না হয় কাকা অথবা কাকাবাবু বলে ডাকতে পার।

–           জি স্যার, না কাকা, কাকাবাবু।

–           এবার বল তোমার এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

–           না কাকাবাবু।

–           শোন মা কোন ব্যাপারে কোন সংকোচ বোধ করবে না, যখন যা সমস্যা হবে বলবে, কাওকে বলতে না পার আমায় এসে বলবে। ঠিক আছে?

–           জি কাকাবাবু, আপনাকে ধন্যবাদ।

–           তোমার লেখাপড়া কতদূর মা?

–           এস.এস.সি পাশ করেছিলাম, এরপর নার্সিং এ ট্রেনিং নিলাম, তারপর আর লেখাপড়া হয়নি।

– লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয়না?

রূপকথা মোবারক হোসেন সাহেবের দিকে তাকাল, বুকের মধ্যে আটকে রাখা ছোট্ট একটা নিশ্বাস বের করে মুচকি হাসির মত করে মাথা ঝাকিয়ে বলল

–         না, হয়না।

মোবারক হোসেন সাহেব জানালার বাইরে তাকাতে তাকাতে বললেন

–         তুমি মিথ্যা কথা বললে তাই না?

–         জ্বি।

–         তোমার লেখাপড়া হলনা কেন? আর্থিক নাকি অন্যকিছু।

–         দুটোই।

–         ও আচ্ছা। তোমাকে যদি আমি লেখাপড়ার জন্য সাহায্য করি তুমি করবে?

–         না।

–         তুমি যে অসম্ভব মেধাবি সেটা কি তুমি জান?

–         জি জানি।

মোবারক হোসেন সাহেব রূপকথার এমন কথায় বেশ অবাক হলেন। সেটা যতটা সম্ভব প্রকাশ না করে তিনি বললেন

–         কিভাবে জানলে?

–         কারণ আমার মেধা আছে।

–         তুমি যে মেধাবি তার প্রমাণ দিতে পারবে।

–         হ্যাঁ, পারব।

–         কিভাবে?

–         আপনি আমাকে কিজন্য মেধাবি ভাবছেন তা আমি জানি।

–         কি জন্য?

–         প্রথম কারণ, আপনি আমার মুখে ফ্লাইং সসার এবং ইউ.এফ.ও এর নাম শুনে বেশ অবাক হয়েছেন, একজন নার্সের মুখে ফ্লাইং সসার কিংবা ইউ.এফ.ওর নাম আপনি শুনবেন সেটা নিশ্চয় আশা করেননি।

–         আর দৃতীয় কারণ?

–         আমি যখনকার কথা বলেছি, অর্থাৎ আপনি যখন আমাদের এতিমখানায় যান তখন সময়টা ২০০১ সাল, আর এখন ২০১০। আপনি যানার চেষ্টা করেছেন ঐ সময়টায় আমার বয়সটা কত? আমি যখন বলেছি আমার বয়স ২২, আপনি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়েছেন আমার দিকে, আমার বয়স শুনে আপনার চমকাবার কারণ নেই, চমকেছেন ১২ বছরের মেয়ে ফ্লাইং সসার কিংবা ইউ.এফ.ও র নাম মনে রেখেছে সেটা ভেবে।

–         তুমি কি জান ইউ.এফ.ও কি?

–         ভালভাবে জানিনা, ভাষা ভাষা জানি।

–         কি সেটা?

–         আনডিফাএন্ড ফ্লাইং অবজেক্ট, রহস্যময় মহাকাশযান বললেও খুব একটা ভূল হবে না।

–         তুমি সত্যি মেধাবি।

রূপকথা হাসে কিছু বলে না।

– আমি এটা নিয়ে গবেষণা বাদ দিলাম কেন জান?

– না, জানি না।

– তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি, নিশ্চয় বলতে পারবে, ভেবে বল।

– না স্যার পারব না, আমি ততটা বুদ্ধীমতি নই।

– আসলে——

কথা বলার এ পর্যায়ে তরীর বাবুটা পাশের ঘর থেকে কেঁদে উঠে, রূপকথা দৌড়ে বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে চলে যায়, মোবারক হোসেন সাহেবের আসল কথাটা আর শোনা হয়না রূপকথার।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to ফানুস-৩

You must be logged in to post a comment Login