এ.বি.ছিদ্দিক

গল্প: বুবুন

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

১১ই জানুয়ারি, রাত ২টা ৩৪ মিনিট।

Happy birthday To you Bubun সোনা, Happy birthday to you.

ঘুম থেকে ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠল বুবুন, সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা ও। বিছানার পাশের বেড সুইচটি জ্বালিয়ে দিয়ে বুবুনের বাবা আতঙ্কিতভাবে জিঞ্জেস করলেন

: বুবুন, কি হয়েছে বাবা?

ঘুমের ঘোর কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বুবুনের মুখ দিয়ে প্রথম যে কথাটি বেরিয়ে এলো, তা হল “মা”।

এই একটি কথা শুনেই বুবুনের বাবা কেমন যেন চুপ হয়ে গেলেন। বুবুনের মা আর বেঁচে নেই, মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল তিনি হেপাটাইটিস B রোগে মারা গেছেন। আজ বুবুনের জন্মদিন, এমন দিনে বুবুন তার মা কে প্রত্যাশা করবে সেটাই স্বাভাবিক। বুবুনের মুখ থেকে তার মায়ের কথা শোনার পর অসম্ভব কান্না পাচ্ছে ওর বাবার, কিন্তু বুবুনের বাবা তা করলেন না, বরং নিজের নিশ্বাসে জমে থাকা হতাশাকে দেহ থেকে মুক্তি দিয়ে, বুবুনকে জরিয়ে ধরে তিনি বললেন

:বুবুন, স্বপ্ন দেখেছ বাবা?

বুবুন কোন কথা বলল না, শুধু হ্যাঁসূচক মাথা নাড়াল।

: মা কে স্বপ্নে দেখেছ বুঝি?

: হ্যাঁ বাবা।

: মা কে খুব মনে পড়ছে?

কথাটা বলতে গিয়ে বুবুনের বাবার চোখটা ধরে এলো, তিনি নিজেকে সামলে নিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে বুবুনকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন, কেঁদে উঠল বুবুনও।

ওরা কাঁদছে। কাঁদছে তো কাঁদছেই, যেন সমস্ত জীবনের কান্না আজ দুজনে একসাথে, একরাতেই শেষ করবে।কিন্তু না, সামনের জীবনের জন্য আরও অনেক কান্না জমা রেখে যতক্ষণে ওরা কান্না থামাল, ততক্ষণে গভীর রাতের ছায়া অবরোধ কেটে দিনের সূর্য উকি দেবে দেবে করছে। বুবুনের বাবা বুবুনের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল

: Happy birthday to you বুবুন সোনা।

বুবুন কোন উত্তর দিল না চুপ করে রইল।

: কি হল বুবুন? আমি তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম, আমাকে ধন্যবাদ, thank you, কিছুই তো বললে না বাবা?

বুবুন ধন্যবাদ অথবা thank you কিছুই না বলে বলল

: বাবা, মা নেই কেন বাবা?

বুবুনের বাবা বুবুনকে নিজের বুকের মাঝে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বললেন

: কে বলেছে তোমার মা নেই, অবশ্যই আছে।

: কোথায় আছে বাবা?

: তোমার মাঝে আছে, আমার মাঝে আছে।

: মা কে খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে বাবা, মা কে কি আমি আর দেখতে পাব?

: পারবে বাবা, শুধু একবার মন থেকে ভেবে নাও, চোখ বন্ধ করে ভাব, নিশ্চয়ই দেখতে পাবে।

:বাবা, তাহলে বোধ হয় আমি সত্যি সত্যি মা কে দেখেছি।

: তাই? কিভাবে দেখলে?

: মা ই তো ঘুম ভাঙিয়ে দিল, কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, Happy birthday to you বুবুন সোনা।

: তাই?

:হ্যাঁ।

বুবুন একটু চুপ করে থেকে বলল

: বাবা?

: বল বুবুন।

: মা কোথায় গেছে?

: মা? মা আল্লাহর কাছে গেছে বাবা।

: বাবা, কেও আল্লাহর কাছে গেলে আর ফিরে আসেনা তাইনা?

বুবুনের বাবা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, কথা ঘোরাবার জন্য তিনি বুবুনকে বললেন

: বুবুন, আজ তো তোমার জন্মদিন?

: হ্যাঁ বাবা।

: তুমি আমার কাছে কি চাও বাবা?

বুবুন ভাবনার মত ভঙ্গি করে চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পর বুবুন বলল

: বাবা?

: বল, বুবুন।

: কি চাইব বুঝতে পারছি না।

: বুঝতে না পারলেও ক্ষতি নেই, অনেক সময় আছে ভাবার, তুমি ভাবতে থাক, যখন মনে পড়ে তখন আমায় জানিও।

: যদি স্কুল থেকে মনে পড়ে বাবা?

: স্কুল থেকে মনে পড়বে না।

: কেন বাবা?

: কারণ আজ তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না।

বুবুন হেসে বলল

: thank you বাবা।

: বুবুন, তুমি এককাজ কর, ঝটপট তৈরি হয়ে নাও, আজ আমরা বাইরে গিয়ে কোথাও খাব।

: সত্যি?

: হ্যাঁ বাবা।

: আমি কিন্তু পিজা খাব?

: অবশ্যই খাবে, পিজা, আইসক্রিম, যা ইচ্ছা তাই খাবে, যত ইচ্ছা খাবে, আমি ও তোমার সাথে খাব।

বুবুন আর কোন কথা বলেনা, দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল বাইরে যাবার জন্য তৈরি হতে।

বুবুন মুক্তিযুদ্ধ গোল চত্তরে দাড়িয়ে আছে, ওর বাবা গিয়েছে আইসক্রিম আনতে। ওর হাতে লাল রঙয়ের ঘড়ি, যেটা আজই একটু আগে ওর বাবা ওকে কিনে দিয়েছে। বুবুন একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর সময় দেখছে, ওর বাবা যখন আইসক্রিম কিনতে যায় তখন ঘড়ির বড় কাটাটা ছিল ৬ দাগে, এখন সেটা এসে গেছে ১০ দাগে। অর্থাৎ ২০ মিনিট হল ওর বাবা আইসক্রিম কিনতে গিয়েছে। কিন্তু এত সময় তো বাবার লাগবার কথা নয়, বাবা তো ওকে বলে গেল ১০ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে, তাহলে এখনও আসছে না কেন? বুবুন ওর বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ঘড়ির কাটার ঘর পরিবর্তন দেখতে ভালই লাগছিল ওর, কিন্তু সেটা ১০ থেকে ১২ ঘরে যাবার পর থেকে আর ভাল লাগছেনা বরং বিরক্ত হচ্ছে। আচ্ছা ও এখন কি করবে? ও কি বাড়িতে ফিরে যাবে নাকি দাড়িয়ে থাকবে? বাবা এসে ওকে না দেখলে অবশ্য দু:শ্চিন্তা করতে পারে সেটা ভেবেই বুবুন দাড়িয়ে রইলো। এমনও তো হতে পারে জন্মদিন বলে বাবা কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সাথে মজা করছে। কিন্তু ঘড়ির কাটা যখন আবার ৬ দাগে ফিরে চক্র পুণ্য করল তখন বুবুনের মনে হল বাবা হয়ত আর ফিরবে না। ওর বাবা যে পথ ধরে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল সে পথে বুবুন চলতে শুরু করল। একটু দূরে এগিয়ে যেতেই বুবুন দেখল, একদল মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, কেও কেও গাড়ির কাঁচ ভাঙছে। আচ্ছা, এদের কাওকে বললে কি তারা বুবুনকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে? বুবুনের পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল, ওদের বাংলা ম্যাডাম বলেছে, যারা মারামারি করে তারা মন্দ লোক, মন্দ লোক নিশ্চয় ওকে সাহায্য করবে না। বুবুন আরও খানিকদূর এগিয়ে যেতেই লক্ষ করল, এক জায়গায় অনেকগুলো মানুষের ভিড়, এতগুলো মানুষ একসাথে কি করছে সেটা খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে ওর। বুবুন ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল।

সবার মতই বুবুন তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে, এক বুক হতাশা নিয়ে আমি ভাবছি বুবুনের ভবিষ্যতের কথা। এভাবেই, হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই তো রোজ রোজ হারিয়ে যাচ্ছে বুবুনদের ভবিষ্যৎত, বুবুনদের বাবারা।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to গল্প: বুবুন

You must be logged in to post a comment Login