এ.বি.ছিদ্দিক

রোদেলা কাব্য

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বাস থেকে দর্গা-তলায় নামতে না নামতেই ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হল। যেন এতক্ষণ বৃষ্টি দেবতা রোদেলার বাস থেকে নামবার অপেক্ষায় করছিল। দুই পা দূরেই বাসষ্টান্ডের ছাউনি। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই বৃষ্টির কবল থেকে রক্ষা পাবে রোদেলা। কিন্তু ও তা না করে চুপচাপ দাড়িয়ে ভিজতে থাকে। ও কেন ভিজছে এই মুহূর্তে সম্ভবত ও নিজেও জানেনা,  শুধু জানে ওকে মতলব হোসেন নামে বিখ্যাত এক শিল্পপতির কাছে যেতে হবে। এতদিন ধরে শাড়ি সাজ সজ্জার আড়ালে যে কুমারী মানুষটাকে লালন করেছে তাকে বিকিয়ে আসতে হবে তার কাছে। মূল্য মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। এই মুহূর্তে কুমারিত্ব রক্ষার চেয়েও ওর কাছে বেশি  গুরুত্বপুর্ণ টাকাটা। তাছাড়া হয়ত আর বাবাকে বাঁচান যাবে না। লিভার সেরেছিস রোগ থেকে বাবাকে বাঁচানোর জন্য এখনো এক লক্ষ টাকা প্রয়োজন রোদেলার। আচ্ছা, একলক্ষ টাকা পূর্ণ হতে কতগুলো পাঁচ হাজার টাকা লাগে? মতলব হোসেন সাহেবের কাছে চাইলে কি ওকে ১লক্ষ টাকা দেবে? নিজেকে ভালভাবে উপস্থাপন করতে পারলে এরা নাকি বকশিস দেয়। কত বকশিস দেবে? পাঁচশ, একহাজার, দুহাজার? কিন্তু বাঁকি টাকা ও কোথায় পাবে? তাহলে কি বাবাকে আর—— ।  রোদেলা কিছুই ভাবতে পারেনা। ও একবার শুধু এদিক ওদিক তাকায়। রাত ৯টার মত বাজে। অন্যদিন নিশ্চয় এমন সময় এখানটায় অনেক মানুষজন থাকে। কিন্তু আজ কাওকেই দেখা যাচ্ছেনা। সবাই নিশ্চয় এমন বৃষ্টির দিনে খওয়া শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিক থেকে ভালই হয়েছে, কুমারিত্ব গেলেও কেও জানতে পারবেনা রোদেলা কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে। সাড়ে নয়টার দিকে এই মোড়ে ই মতলব হোসেন সাহেবের গাড়ি রোদেলার জন্য অপেক্ষা করবার কথা, কিন্তু কই কাওকেও তো দেখা যাচ্ছে না। কোন গাড়ি ই তো নেই। তাহলে কি কেও আসবে না? বাবার চিকিৎসার কি হবে? যূথী, শান্তা, সুমন ওদের নিয়ে ও কোথায় যাবে? অজানা অস্থিরতা ও হতাশায় রোদেলার বুকের ভিতরটা খা খা করে ওঠে। যে মা কোনদিন সন্ধ্যার পরে ওকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি সে আজ রোদেলাকে রাত করে বাইরে আসছে জেনেও কিছু বলেনি। টাকা বাদে এখন ফিরলে কিভাবে মার কাছে মুখ দেখাবে ও? কিভাবে বাঁচাবে বাবাকে? কার কাছে যাবে? রোদেলা নতুন করে কিছু ভাবার আগেই ওর চোখ দিয়ে লোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ও কাঁদতে থাকে।

৯টা ১৭ এর দিকে রোদেলার পাশে এসে কালো মতন একটা মাইক্রো-বাস এসে থামল। হ্যাঁ, কালো মাইক্রো-বাসের কথা ই তো বলেছিল রোদেলাকে। মাইক্রো-বাসের ভেতর থেকে কালোমতো একটা লোক জানালা দিয়ে মুখটা বের করে দেয়। সে পিচ করে মুখের ভেতর থেকে একগাল পানের পিক রাস্তার উপর ফেলে রোদেলার দিকে হাসি হাসি মুখ করে গলায় ঝোলান একটা কার্ড দেখাতে দেখাতে বলে

: কি গো মাইয়া, ভিজ ক্যান? শইল খারাপ করব তো। তাড়াতাড়ি গাড়িতে আহ, উইঠা বহ। আমরা স্যারের লোক, এই দেহ কাড।

রোদেলা কোন কথা বলে না, চুপ করে গাড়িতে উঠে বসে। ওর একদম পাশে এসে বসে লোকটা। সে তোয়ালেটা রোদেলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে

: আমার নাম নুরু, নুরু আব্দুল্লাহ। স্যারের পেয়ারের লোক, তোমার নাম কি গো মাইয়া?

রোদেলা আস্তে করে বলে

: রোদেলা।

নুরু রোদেলার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হেসে উঠে। তার হাসি দেখে রোদেলার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে আসতে চায়। নুরু মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা পানের রস টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বলে

: এ লাইনে কতদিন আসছ? নতুন, তাই না?

রোদেলা অবাক হয়ে নুরুর দিকে তাকায়, তাহলে কি এই লোকটা সব জেনে গেছে? সে কি ভাবছে রোদেলাকে? মতলব হোসেন নামের লোকটা ঘরের মধ্যে জানালা, দরজা বন্ধ করে কি করবে তা কি জেনে গেছে এই কালো লোকটা? ছি ছি ছি!! এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে রোদেলার। ইচ্ছা হচ্ছে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিতে। কিন্তু সেটা করা যাবেনা। যেকোনো ভাবেই হোক ওকে টাকাগুলো জোগাড় করতে হবে। বাবাকে বাচাতে হবে।

: এ লাইনে কতদিন আসছ কইলা না?

রোদেলা প্রায় চমকে উঠে বলল

: অ্যাঁ?

নুরু রোদেলার চমকানো ভাব দেখে সজোরে হাসি শুরু করলে। এই মূহুর্তে তাকে দেখে রোদেলার হায়নার মত লাগছে, তার হাসিতে রোদেলার সামান্য ভয়ের মত ও লাগছে।

: বুঝছি এ লাইনে আজই পইলা আসছো তাই না?

রোদেলা কিছু বলে না শুধু মাথা ঝাঁকায়।

: প্রথম প্রথম এমন লাগব, লাজ করব, পরে দেখবা সব ডাইল ভাত, একটুও লজ্জা করব না। সব ঠিক অইয়া যাইবো। স্যারের সাথে কত টাকার মিটমাট করছ?

: পাঁচ হাজার।

: মাত্র পাঁচ হাজার। এ তো খুবই কম রেট। তোমারে তো নতুন পাইয়া স্যার ঠকাইছে। কিন্তুক আমি আছি, কোন টেনশন লিও না। দশ হাজার এর ব্যবস্থা কইরা দিব ইনশাল্লাহ। খুশি তো?

রোদেলা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়।

: আলহামদুলিল্লাহ কও।

রোদেলা ফিসফিস করে কিছু বলে, কিন্তু কি বলে সেটা নুরুর কান পর্যন্ত পৌঁছে না।

: স্যার, এমনে লোক ভালা, হ্যায় খারাপ না, সে যা যা কইব সব শুনবা, মানি আলা লোকেগো সাথে গোসসায় যাইবা না।

রোদেলা চুপ করে শোনে কিছু বলে না। তবে এই মুহূর্তে নুরু লোকটাকে আর হায়নার মত লাগছে না।

: বলছি, আমগোর সাথে, বিশেষ কইরা আমাগো ড্রাইভার সাব রুস্তম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাইখো। কি রুস্তম ভাই?

গাড়ির ড্রাইভার রুস্তম সামনে থেকে সায় দেয়। হঠাৎ করেই নুরু রোদেলার ডান পায়ের উরুতে হাত দিতে ই রোদেলা চমকে ওঠে। তার চমকানো দেখে নুরু হাসতে হাসতে বলে

: না, না সাহেবের নিষেধ আছে, আগে সাহেবের কাছ থাইক্যা ফিরে আস, তারপর আমগো দিকে একটু নেক নজর দিলেই হইব, সব মিলাইয়া বার হাজার টাকার ব্যবস্থা কইরা দিব ইনশাল্লাহ। রোদেলার আকাশ ভেঙে কান্না আসতে চায়। কিন্তু চোখ দিয়ে জ্বল গড়াবার আগেই গাড়ি মতলব হোসেনের মস্ত বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

রোদেলা চুপ করে খাটের উপর আধা নগ্ন অবস্থায় শুয়ে আছে। ওর সামনের মতলব হোসেন সাহেব। তিনি কার যেন মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। এই মানুষটাকে প্রথম দেখায় লজ্জা করলেও এই মুহূর্তে আর লজ্জা করছে না। নিজেকে ভালভাবে উপস্থাপন করলে এরা নাকি বকশিস দেয়, কিন্তু রোদেলা বুঝতে পারছে ও নিজেকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করবে। মতলব সাহেব হাসিহাসি মুখ করে ফোন রেখে রোদেলার কাছে ফিরে আসলেন।

: তুমি লাকি কয়েন এ বিশ্বাস কর রোদেলা?

মতলব আলীর মুখে নিজের নামটা শুনতে আরও একবার চমকায় রোদেলা। সে অবাক হবার ভঙ্গিতে বলে

: আপনি আমার নাম জানেন?

মতলব সাহেব হাসে, তারপর রোদেলার ব্লাউজ ওর দিকে এগিয়ে দিতে বলে।

: আমি তোমার সবকিছুই জানি, নিজেকে টিকিয়ে রাখতেই আমাকে সব জানতে হয়।

: ও আচ্ছা।

: কি লাকি কয়েন এ বিশ্বাস কর?

রোদেলা নাসূচক মাথা ঝাঁকায়।

:আমি করি, খুব ভালভাবেই বিশ্বাস করি। ব্লাউজটা পরে নাও।

রোদেলা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারেনা। কি বলছে আধা বয়সি এই লোকটি? ওকে স্পর্শ না করে বলছে ব্লাউজ পরে নিতে?

মতলব হোসেন আবারও বলেন

: তুমি এককাজ কর, বাড়ি চলে যাও।

: জি? বাড়িতে চলে যাব?

: হ্যাঁ। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আজ আমি ছয় কোটি ডলারের একটা টেন্ডার পেয়েছি।

রোদেলা ব্লাউজ পড়তে পড়তে বলে

: কিন্তু স্যার—

মতলব হোসেন রোদেলাকে থামিয়ে দিতে দিতে বলে

: তোমার টাকার ব্যাপারটা তো?

: জি।

: কত টাকা লাগবে তোমার বাবার চিকিৎসার জন্য? একলক্ষ টাকা বাঁকি তাইতো?

: হ্যাঁ।

: আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, ও তোমাকে পৌঁছে দেবে। তুমি কোথায় যাবে? বাড়ি, নাকি হাসপাতাল?

: বাড়িতে।

: আর নুরুকে বলে দিচ্ছি, ও তোমার বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।

একথা শোনার পর রোদেলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। ও মতলব হোসেনকে ছালাম করতে যায়। মতলব আলি হাতের ইশারায় তাকে নিষেধ করে, চলে যেতে বলে।

রাত একটার মত বাজে। বাইরে অসম্ভব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। সেই চাদের দিকে তাকিয়ে রোদেলার মনে হয়।  প্রকৃতির কাছে কিছু চাইতে নেই, সে তার মঙ্গলময় বাহু দিয়ে নিজের সন্তান ভেবে সবসময় আমাদের আগলে রাখে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to রোদেলা কাব্য

You must be logged in to post a comment Login