আল মামুন খান

ছোটগল্প: সন্ধ্যা নেমে এলো

ছোটগল্প: সন্ধ্যা নেমে এলো
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে!

রংধনুর রং এর লুকোচুরি দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। সোনালী বিকেলটাকে আবার এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে পাবো ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই নীলচে কালো মেঘেরা সব গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশটাকে দখল করে নিলো। টিউশন শেষ করে মেসে ফেরার তাড়া ছিল না। তাই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি আর ঠোঁট না নাড়িয়ে গুনগুন, ‘কত যে কথা ছিল, কত যে বেদনা…’। ঠোঁট না নেড়ে কখনো গুনগুন করেছ? এটা নাকের বাঁশী ও কন্ঠনালী ব্যবহার করে করতে হয়। গানের কলি শুনলে মনে হচ্ছে যে কতটা দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছি। আসলে তা নয়। তবে একেবারেই যে দুঃখ নেই তাও না। সুখও নেই, দুঃখও নেই। এটাকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি যেন হয়?

পকেটে একটা টাকাও নেই। রিক্সার দশ টাকার পথ হেঁটে মেয়েটিকে পড়াতে যেতে হচ্ছে। আজ তিনদিন ধরে। মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই মাস আবার একত্রিশে । কেন, সব মাসগুলো ত্রিশ দিনে হলে কি হয়? আরো পাঁচ দিন এভাবে যেতে হবে। অন্যরা সপ্তাহে তিন কি বেশী হলে চার দিন পড়ায়।আর আমার বেলায় একদিন বন্ধ রেখে প্রতিদিন। চেহারায় কিছু একটা আছে হয়তো। অভিভাবকেরা প্রথম দেখায়-ই বুঝে যায়। কলুর বলদ একটাকে পাওয়া গেছে। অবশ্য আমি বলদ হলেও পড়াই ভালো। যাদের রেফারেন্সে টিউশন দিতে আসি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ভালোই বলে। অন্তত আমার একাডেমিক রেকর্ড তো সে কথাই বলে।

আজ দেড় বছর এই টিউশন এর ওপরই বেঁচে আছি। এটা বললে মোল্লারা আবার ক্ষেপে যাবে নাতো? ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ…’ বলে শাপলা চত্বরে আমার বিরুদ্ধে আমরণ অনশনে না বসে যায়। কি করব বল। চাকরি পাই না। প্রথমদিকে অনেক ইন্টারভিয়্যু দিয়েছি। একটা হ্যান্ডবুকই লিখে ফেলতে পারতাম মনে হয়। ‘দ্য হ্যাণ্ডবুক অফ এ আনএমপ্লয়েড ভ্যাগাবন্ড’ নামটি কেমন হয়? আসলে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। এখন যদি তোমরা কেউ জিজ্ঞেস কর যে কি ‘যোগ্যতা’ লাগে, আমার অনেক সময় নষ্ট হবে। এমনিতেই আমার সময় নেই… এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে ছ’টায় নির্দিষ্ট একটা যায়গায় থাকতে হবে।

একজন অপেক্ষা করবে।

আজ ক’দিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই আজ পালানো যাবে না। তবে আমাকে রাত কাটাতে হবে কোনো পার্কে বা স্কুলের বারান্দায়। কারণ সে সোজা আমার মেসে চলে আসবে। আমি জানি। এবং ওকে আমার থেকেও বেশী জানি। কলি এ ধরনেরই মেয়ে।

একটা বিড়ি খাইতে পারলে মন্দ হতনা। বিড়ি শুনে আবার নাক কুঁচকে ফেলোনা। সিগ্রেটকে আমি বিড়িই বলি। বিড়ি হোক আর সিগ্রেট হোক… জ্বালিয়ে ছারখার করবে তো আমাকেই। এ জীবনের মত! একটু পা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করি। সামনে এক ভদ্রলোক (নাহ! তাঁকে ভদ্রলোক বলা যাবে না। সে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে… আইন ভাঙছে। ভদ্রলোকেরা আইন মেনে চলবে।) ধুমপান করতে করতে হাঁটছে। ওনার সিগ্রেট টা ফেলে দিলে না হয় দু’তিন টান দিতে পারব।

অভদ্রলোকটির ফেলে যাওয়া সিগ্রেটের শেষাংশে কষে তিনটি টান দিতে পারলাম। নিকোটিনের বিষে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিতে যে কি আনন্দ! এই একই আনন্দ পাই যখন কলির পাশে বসে বসে ওর বকা শুনি… ‘এটা পারো না… কেন এমন হল… এত দেরী কেন… এই, তুমি আবার সিগ্রেট খেয়েছ’ ইত্যকার হাজার রকমের কেন শুনে শুনে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর না শুনলে ভালো লাগে না। কলি আমার ভ্যাগাবন্ড জীবনের অন্যতম নেশা।

আজ কলিকে আমার নিজের একটি অনুভুতির কথা বলতে হবে। আরে, অন্য কিছু ভেবে বস না আবার। সেদিন হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। কলি চুপচাপ আমার আবৃত্তি শুনল। আমার শেষ হলে বলল, ‘ আমাকে স্পর্শ কর, নিবিড় স্পর্শ কর নারী’ এই লাইন আমাকে বুঝিয়ে দিবে।এখানে প্রথমবার স্পর্শ দিয়েও কি তাঁর অনুভুতি হয়নি, আবার নিবিড় স্পর্শ কথাটি কেন বললেন?’

কি বিপদে পড়লাম দেখ দেখি। ওকে খুশী করার জন্য রাত জেগে জেগে কবিতা মুখস্ত করি। আমার একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর আগে এর ছিটেফোটাও যদি করতাম… হয়তো আরো… বেটার কিছু হতো।

কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘ …লটা হইত… তুই ব্যাটা এখনো যা আছিস, তখনো তাই-ই থাকতিস… এখন এভাবে হাঁটার উপরে থাক।’ চারপাশে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখি না। সকালে স্টিকে টান দিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না।

যখন কলির কাছে পৌছালাম, অলরেডি দশ মিনিট লেইট হয়ে গেছে। বসের সামনে দাঁড়ানোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম দেরীর কারন জানতে চাইল না। বলল,

– তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম, করেছ?

‘ কোন কাজটা যেন?’

এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো, আমার তাতেই হয়ে গেল।বললাম,

‘ না, মানে এতো ব্যস্ত থাকি যে সব কিছু কেমন আউলা হয়ে যায়। একটু মনে করে দিলে ভালো হয় ডার্লিং!’

– দেখ, আমার সাথে তুমি ফাজলামো করবে না। তুমি হেঁটে আসার পথে এইগুলো নিয়েই ভাবছিলে। কি, মিথ্যে বলেছি?

আমি ভেবে পেলাম না, ও কীভাবে জানল আমি কি ভাবতে ভাবতে এসেছি ! বললাম,

‘ডার্লিং, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না… আমি ঐ কবিতার লাইনটির অর্থ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু…’

– কিন্তু কি?

‘আমার মাথায় একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই গতকাল থেকে। কোনোভাবেই বের হচ্ছে না…’

– কোন গানটা?

‘দুশমনি করোনা প্রিয়তমা’ এইটা। মাথায় বাজতে বাজতে শেষে ‘দুষ্টুমি করোনা প্রিয়তমা’ হয়ে যাচ্ছে।’

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে কলি বসে পড়ল। ওর মুখ থমথমে… ওর নাকের নীচে গোঁফের যায়গাটায় হাল্কা ঘাম জমেছে… বড়ই ভালো লাগছে! আমার বুকের ভিতরে কিসে যেন টান মারল… আমি ভাবলাম, কেন ওর সাথে এরকম করছি? ও যা চায়, সেটা করলে ক্ষতি কি? পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, আমার মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে ওকে মানায় না। আমি ওকে কোনো সুখই দিতে পারব না। তবে কেন ওর সাথে মায়ায় জড়ানো?

আমাকে কলি ওর পাশে বসতে বলল। আমি বসলাম। ওর শরীর থেকে খুব সুন্দর হাল্কা অচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। ওকে আরো বেশী করে একজন নারী মনে হল… খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু একটু আগের নিজের অনুভুতি ভেবে এখনকার অনুভুতির গলা টিপে ধরলাম। সে আমার একটা হাত ধরল… আমি কেঁপে উঠলাম। আমাকে বলল,

– আর আমার মাথায় জগজিৎ বসে আছে… ভাবতো রেইল লাইন ধরে হাঁটছি… খুব চেনা পথটি ধরে… আর জগজিৎ কানে কানে বলছে…’মুঝে তুম সে মোহাব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়… ইয়ে দুনিয়া খুবসুরৎ হো গ্যায়ি হ্যায়… উফ! কখন যে সন্ধ্যা হবে!

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কলি পাগল টাগল হয়ে গেলো না তো! ওর হাত ধরা অবস্থায় শরীরও তেমন গরম অনুভব করলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। সে ও মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। বললাম,

‘সন্ধ্যা হলে কি তুমি খুশী হও?’

– হ্যা! কেন তুমি হও না?

‘নাহ, সন্ধ্যা হলেই আমার সেই মেসের জীবন শুরু হবে। তুমি তো তোমার বাসায় চলে যাবে। আমার একেলা জীবন… একেবারে সেই পরেরদিন তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত।’

– একেলা জীবন মানে মেসের জীবন কি খুব কষ্টের?

আমি হাসলাম। কলি একটু বিব্রত হল। বললাম,

‘সন্ধ্যা নামতেই যখন চারিদিকে আঁধার হয়ে যাবে… আমার মেসের দরোজা আমার জন্য উন্মুক্ত হবে। রাত আমার কাছে কোনো আনন্দই আনে না। কাঠের চৌকি আর অন্ধকারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকারা আমাকে কুরে কুরে খাবে…ইদুর দৌড়ে যাবে রাতের অন্ধকারে… আমি ইদুরের শিরীরের ঘ্রাণ পাবো…রুম মেটের নাক ডাকার শব্দে আমার বিনিদ্র রজনি কেটে যাবে…

দিনের বেলায় আবার আমি সেই সবার চির পরিচিত আমি…হাসবো… হাসাবো… কিন্তু কাঁদব একা একা! ভাবতে পারো? একজন মানুষ কতটা রূপ নিতে পারে… আমি আমার এতোগুলো ফেইক আইডি বানিয়ে এক একজনের চরিত্রকে আমার নিজের ভিতরে ধারণ করতে চেয়েছিলাম

কখনো আমি নর…কখনো নারী… কিংবা বয়ষ্ক প্রেমিক পুরুষ অথবা নাবালিকা শিশু

সব রুপেই আমি আমাকে চিনতে চেয়েছি… মানুষ কে উপলব্ধি করতে চেয়েছি…কিন্তু বারে বারে ফিরে পেয়েছি এই আমিকে…এখন যেমন রয়েছি…সেই আদি ও অকৃত্তিম আমাকে।’

কলি আমার হাত ধরে বসে আছে… ওর দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে… ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসে… এতোটা কাছে যে আমাদের দুজনের নাকে নাক লেগে যায়… জীবনে এই প্রথম সে আমার ঠোঁটে তাঁর ঠোঁট ছোঁয়ায়… আমিও সাড়া দিতে বাধ্য হই… নিজেকে মনে হচ্ছিল একজন শিক্ষানবিস। যে তাঁর টিচারের কাছ থেকে ডীপ কিসের লেসন নিচ্ছে।

ভালোভাবে লেসন নেয়া হয়ে গেলে কলির চোখে চোখ রেখে বললাম,

‘তোমার কবিতার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ?’

– কিভাবে?

বললাম, ”আমাকে স্পর্শ কর, নিবিড় স্পর্শ কর নারী” – এখানে তুমি প্রথমে আমার হাত ধরে ছিলে… নিজের অজান্তে। সেটিই ছিল আমাকে স্পর্শ করা… একজন নারীর সাধারণ স্পর্শ। আর চোখের জ্বলে সিক্ত হয়ে পরবর্তীতে যে স্পর্শ করলে, সেটি ছিল আমার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় তোমার স্বেচ্ছায় কাছে আসা। এই স্পর্শকেই কবি নিবিড় স্পর্শ বুঝিয়েছেন।’

-বাহ! এতো সুন্দর করে বুঝালে!

‘আমি কোথায় বুঝালাম? সবতো তুমি ই…’

সন্ধ্যা নেমে এলো… বলাকাদের মতো আমরা দু’জনেও ফিরে যাচ্ছি… যে যার ডেরায়। আমার এখন আর মেসের পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে না। ছারপোকা এবং ইঁদুরদেরকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। মায়া লাগছে…

মায়ার এক অফুরন্ত জগতের ভিতর নিজেকে জড়িয়েছি যে!

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login