এ.বি.ছিদ্দিক

সমতল

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

জহুরূল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বারবার বারান্দার এদিক ওদিক হাটাহাটি করছেন আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। রাত ১০টার মত বাজে। রাত খুব বেশি না হলেও তার একমাত্র মেয়ে শিলার বাড়িতে ফেরার জন্য সময়টা যথেষ্ট বেশি। কেননা শিলা কখনও সন্ধ্যার পর বাইরে থাকেনা, বাড়ি থেকে কাওকে কিছু না বলে বের ও হয়না। শিলার জন্য খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। দুশ্চিন্তার পাশাপাশি রাগও হচ্ছে। রাগটা অবশ্য শিলার উপর নয়, তার মায়ের উপর। ১০টা বাজার পর থেকেই সে ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির ভেতরে সবাই শিলার খোঁজখবর করা বাদ দিয়ে এখন তার মায়ের জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত। জহুরুল সাহেব বারান্দা থেকে বাড়ির ভেতরে গেলেন। আর বসে থাকলে চলবে না। এ যুগের মেয়ে হয়েও শিলা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে দরকার হলে বাবার মুঠোফোন থেকেই কথা বলে। সে সুবাধে জহুরূল সাহেবের মুঠোফোনে শিলার কিছু বন্ধুর নাম্বার সংরক্ষিত আছে। জহরূল সাহেব তাদের একজনকে ফোন দিতে গিয়ে দেখলেন ফোন করবার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই। প্রয়োজনের সময়টাই তিনি হাতের কাছে কিছু যেমন কাছে পান না, তেমনি কাওকে পাশেও পান না। বাইরে হাল্কা হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি তার মধ্যে বের হলেন। বাড়িতে বসে থাকলে এখন আর সমস্যার সমাধান হবে না। বাড়ির পাশের ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে মোবাইলে টাকা ভরে তিনি শিলার  বন্ধুদের একে একে সবাইকে ফোন দিলেন। তারা কেও কিছু জানে না, ফোনে সেভ করা শিলার সকল বন্ধুদের সঙ্গে কথা হল কিন্তু তারা শিলার কোন খোজ দিতে পারল না, এমনকি তারা অন্য যে সমস্ত বন্ধুদের ফোন নামবার দিল তারাও কোন খোজ দিতে পারল না শিলার। শুধু একজন জানাল প্রাইভেট পড়ে শিলা আর সে একই সঙ্গে একই বাসে ফিরছিল, মাঝপথে সে যখন বাস থেকে নেমে গেছে তখন সাড়ে ছয়টার মত বাজে। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরতে শিলার ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগবার কথা নয়। কিন্তু চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, তবু মেয়েটা এলোনা। বিপদের আচ যেন ভালো ভাবেই ঠিক পাচ্ছেন জহুরূল সাহেব। শিলার আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলার চেষ্টা না করে তিনি তার শশুর বাড়ি, বোনদের বাড়ি খোজ করলেন, শিলা সেখানেও নেই, সম্ভাব্য থাকার জায়গা সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, শিলাকে তবু পাওয়া গেলনা কোথাও। রাত ১২টার দিকে তিনি পরিবহনের লোকেদের সঙ্গে কথা বললেন। তারা জানাল, আজ চাটমোহর থেকে তেনাচিড়া পর্যন্ত কোন এক্সিডেন্ট ও হয়নি। তারপরও তিনি হাসপাতালগুলোতে খোজ নিলেন। শিলার মত কেও ভর্তি হয়নি হাসপাতালে। হাসপাতালগুলো থেকে তিনি যখন খোজ নিয়ে ফিরলেন তখন রাত একটা বাজে, তিনি ভেবেছিলেন বাড়িতে এসে তিনি শুনবেন মেয়ে ফিরেছে। মনে মনে তিনি বহুবার বলেছেন

: হে আল্লাহ আমার মেয়ে যদি ভালই ভালই ফেরে, এমনকি মস্ত বড় কোন অপরাধ করেও ফেরে আমি ১০০০ রাকাত শুকুরানা নামাজ পড়ব খোদা। তুমি আমার মেয়েকে ফেরত পাঠাও।

কিন্তু তার দোয়া আল্লার দরবার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। শিলা বাড়িতে তখনও ফেরেনি শুনে জহরূল সাহেব বাড়ির বারান্দায় অসহায় আর ক্লান্ত ভঙ্গীতে বসে পড়লেন। আর ঠিক এমন সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় সাদা রঙের একটা মাইক্রোবাস দ্রুত এসে থামল। সেখান থেকে কি একটা যেন টুপ করে পড়ল, তারপর মাইক্রোবাসটা কালো ধোয়া ছেড়ে যেমন দ্রুত গতিতে এসেছিল তেমনি দ্রুত গতিতে চলেও গেল। কি মনে হয়ে জহুরূল সাহেব দৌড়ে সেখানে গেলেন। গিয়ে তিনি যা দেখলেন তাতে তিনি হতবাক। শিলা অর্ধ নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। জহুরূল সাহেব শিলার বুকের কাছটায় কানটা নিয়ে হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করলেন। তিনি এদিক ওদিক তাকালেন। কাওকে সাহায্যের জন্য খুঁজছেন তিনি । তিনি চিৎকার করে কাওকে ডাকার চেষ্টা করলেন কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন কথা বের হলনা। শুধু বহু কষ্টে একবার বলে উঠলেন, ডাক্তার।

এরপর  দশটি বছর কেটে গেছে। শিলার ধর্ষকদের কোন বিচার হয়নি, বিচার চাওয়াও হয়নি। শিলার পরিবার সে ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। শিলার বিয়ে ও হয়েছে সুপাত্রে। ওর দারুণ ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। জহুরূল সাহেব শখ করে নিজে নাতনির নাম রেখেছেন নিঝুম। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে শিলা আর তার মেয়ে নিঝুম জহুরূল সাহেবের বাড়ি বেড়াতে আসে। জহুরূল সাহেব নিঝুমের সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলা করেন অনেক রাত পর্যন্ত। একসময় শিলা নিঝুমকে ঘুমাবার জন্য জহুরূল সাহেবের ঘর থেকে নিতে আসে। জহুরূল সাহেব শিলার কাছে নিঝুমকে হস্তান্তর করেন। নিজের মেয়েকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান, কিন্তু পারেন না। শিলার মুখের দিকে তাকিয়েও থাকতে পারেননা তিনি। শিলার মুখের দিকে তাকালে আরও একটা মুখের স্মৃতি ভেসে উঠে। মুখটা তাদের বাড়ির দারোয়ান জাফর গার্ডের মেয়ে ছাবিনার। আজ থেকে বহুবছর আগে গভীর রাতে জাফর গার্ডের অনুপস্থিতিতে তিনি যে মেয়েটির ঘরে ঢুকেছিলেন।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to সমতল

You must be logged in to post a comment Login