মামুন ম. আজিজ

বিনা মেঘের বৃষ্টি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


বিনা মেঘের বৃষ্টি


চাতক পাখির নাম শুনেছ? আমি যখন শুনেছি তখন শুনেছে অবশ্যই সকলে। হয়তো দেখেনি তার ত্রিমাত্রিক অবয়বখানা অনেকেই। সেটা মানা যায়। তারপরও আমরা চাতক পাখির মত হয়ে যাই। কারন ঘন্টা ধরে ধরে আকাশে মেঘ ঘন হয় এবং উড়ে যায় এপাশ থেকে ওপাশে। ধূসর একটা ঘনঘটা ছায়ায় ছেয়ে যায় ধরনীতল। হিমেল বাতাস সুরসুরি ধরনের একটা আমেজে মন নাড়া দিযে যায়। কিছু ধুলো উড়ে যায় , কিছু ৃৃউড়ে আসে এলোমেলো। কিছুটা ঝড়ের মত। অথচ ঠিক ঝড় নয়। আমরা চাতকের মত প্রতীক্ষায় । দু এক ফোঁটা মায়ার মত ঐ এলো বলে । কিন্তু বিশাল ধরনীতলে দু এক ফোঁটা আর কি? বৃষ্টি  হলো  না অবশেষে।

বৃষ্টি না হোক। নাই বা হলো । পালিয়ে যাবে কোথায়। কিন্তু সময়টুকু বৃথা হয়ে গেলো। ঘন্টা দুয়েকের। সময় তো কতই নষ্ট হয়। চার ঘন্টার সেই সে পরীক্ষার হলে। উত্তর যতটি দেয়ার প্রয়োজন তার সবই লিখে ফেললাম। দু ঘন্টা তখন সবে গত হয়ে আরও ২৫ টি মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। হয়তো আরও লেখা যেত। আশেপাশের অনেকেই লিখছিল। কিন্তু আমার ঘটে আর কোন কিছু হাতড়ে, সাঁড়াশি দিযে খুঁচিয়েও বের করতে পারলাম না। সবই তো লিখেছি। চার ঘন্টা শেষ না হলে হল থেকে বের হওয়া যাবে না। দেড়টি ঘন্টা কত যে তীব্র যন্ত্রনা গায়ের লোমকূপে লুকিয়ে পার করলাম। কি ক্ষতি হলো?

কিন্তু সেই সময় আর এই দু’ ঘন্টা কি এক!
দীপন তো তৈরী হয়ে বেরই হয়েছিল। যখন  কল দিলাম তখন ও লিফট থেকে বের হচ্ছে। আমি তখন রেডি হব হব ভাব। সব সময় আমি অমনই করি। ছেলে মানুষের একটু অপেক্ষা বিষয়টিতে অভিজ্ঞ হতেই হয়। ও রিকশায় উঠবে তখন আমি সাজ শুরু করব। ও যখন লেকের ধারে আমাদের চিরায়ত মিলন স্থলে পৌঁছবে আমি তখন ঘর থেকে বের হব। ধৈর্য্য না থাকলে পুরুষ মানুষের আর কি থাকে। প্রেমিকার বিলম্ব প্রেমিকের কাছে ক্ষীণ সুরে অনুযোগ এবং তারপর সহজে মেনে নেয়ার মত সহজ বিষয়। উল্টো দিকে প্রেমিকের বিলম্ব প্রেমিকার কাছে অমার্যনীয় পাপ । তবে সে পাপের রেষ ধরে প্রেমিককে কাবু করা সহজ হয় নারীে । আমরা তেমন দরকার নেই। দীপন আমর রূপ গুনে এবং প্রেমের পরাকাষ্ঠায় এমনেতেই কাবু। এটুকু না বুঝলে আমি আর কি নীলিমা হলাম।

দীপন যখন এপার্টমেন্টের গেটের কাছে পৌঁছালো তখন তার কানে আমার কণ্ঠ সুধা ঝরছে। বাতাসের মিথ্যে ঝড়ো খেলা তখন বাড়ছিল। বৃষ্টি না হয়েই পারে না। আমি ওকে গেটের কাছেই দাঁড় করিয়ে দিলাম। স্পষ্ট চোখে দেখছি। গেটটা খুব পরিচিত। মোট তিনবার গিয়েছি দীপনদের ফ্ল্যাটে। চুরি করিনি। তবে ছেলে বন্ধু কিংবা প্রেমিকার খালি বাসায় ঢুকতে গেলে মনের ভেতর সেই ভাবটা আসে। তখন চারপাশ একটু সতর্ক দৃষ্টির বাঁধনে আটকে যায়। আমারও হয়তো তাই হয়ে থাকবে। স্পষ্ট দেখছি গেটের বাইরে সটান দঁড়ানো দেবদারু গাছের যে ডালটার কিছূ পাতা গোপনে প্রেমিকের বাসায় ঢোকার মত গেইট গলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে সেগুলো ঝড়ো বাতাসে কাঁপছে। তার সামনে দীপন দাঁড়িয়ে।

বললাম,  ‘জান আমার, বৃষ্টি শুরু হযে যাবে মনে হচ্ছে, এখন কি বের হওয়া ঠিক হবে?’
ও বললো, ‘তুমি এখনও বের হওনি? তোমাকে আরও দশ মিনিট আগে জানালাম আমি বের হচ্ছি।’
‘কিন্তু তুমি তো বের হলে মাত্র।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে বের হও ।’
‘কিন্তু বের হবার সাথে সাথে বৃষ্টি নেমে এলে। আমাকে ভেজাবে!’
‘খুব ভালো তো। ভেজা চুলগুলো কপোলে তোমার মিশে যাবে। দু এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে জল। ঠোঁটটাতে গুড়ি গুড়ি কণা আমাকে কাছে ডাকবে, আর আমি…’
‘হুম । বলল! একটা। আর আমার কাপড় চোপড়। সবগুলো পশু পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি ভেজা কাপড়ের সাথে দেহের নিবির স্পর্ষে যৌন সুরসুরি খুঁজবে।’
‘তাহলে , কি করব। আমি তো বের হয়ে গেছি।’

‘একটু ওয়েট কর জান। বৃষ্টিটা শুরুই হোক। ঝড়োবৃষ্টির পালা শেষে হলে তারপর একটা রিকশা নিয়ে রওয়ানা দেবে। আমাদের বাসার ডান দিকের বাড়িটার কোনায় দাঁড়াবে। আমি এক দৌড়ে সানসেটের নিচ দিয়ে দিয়ে পৌঁছে যাব। তারপর রিকশায় বসব। হুট ফেলার অনুমতি পাবে । আর সেটা পেলে…’

‘তুমি , তুমি রাস্তায় ঠোঁট ছুুঁতেই দেওনা হাত দিয়ে, আর অধর পরশ…’

‘ওমন বৃষ্টির মাঝে তোমার সন্নিবেশে, আমি কি মানা করতে পারব। এতটুকু মায়ার বন্ধনে তুমি তো বেঁধেই ফেলেছ কবে। তোমাকে দেয়ার কি আর বাকী রেখেছি বল।’

‘ঠিক আছে। তাহলে তুমি রেডি হয়ে থাক। বৃষ্টি শুরু হলেই আমি আসছি।’
‘গুড বয়। সো নাইস জান।’

তারপর দু’ ঘন্টা। মাঝে একবার কল দিলাম ।  দীপন কিছুটা বিরক্ত। খ্যাপেছে।
বলল, ‘নীলিমা, সব তোমার জন্য। তখন বের হলে কি হতো। এখন আর সময় আছে। সন্ধ্যা হতে চলল বলে। থাক । বাদ দাও।’
‘জান । রাগ করে না। প্লিজ। এইতো বের হচ্ছি। রেডি হতে পাঁচ মিনিট।’
‘এখনও রেডি হওনি!’
‘রেডি মানে এই একটু চুলটা …আসলে বৃষ্টি হবে ভেবে চুল খোলাই রেখেছিলাম।’
‘খোলা চুলেই এসো।’

‘এত বাতাসে!’
‘তোমার আসতেই হবে না। আজ বাদ দাও। আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি।’

ফোন টা কেটে দিল।
তারপর আর দেরি করি নিতো। বাতাসের পরশের হাত থেকে সরে আসর জন্য জানালার কাছ থেকে ভেতরে এলাম। চুল শুধু না। আমি তখনও পোশাকটাও বদলাই নি। নিজের উপর রাগ এসে মনে বৃষ্টি হীন ঘন মেঘের মতই ছেয়ে গেলো।
তবুও দ্রুত তৈরী হতে শুরু করলাম। মনে মনে ভাবছি, মাকেও কিছু বলা হয়নি। এখন কি যে বলি। পরিকল্পনা তো ছিলই। আরেকটু সেটা মনে মনে পাকিয়ে নিলাম। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা এই কাজে খুব উপকারে আসে। তনুজার বাসায় যাওয়ার একটা উছিলা মাকে বোঝানোর মত অভিজ্ঞতা বহুবারের। কখনও পরাজয় আসে নি। এবার কেনো আসবে? সেটা কি মেঘের আঁধার আর ঝড়ো হাওয়ার কারনে। কিন্তু মাকে বোঝাতে হবে গুরুত্ব।

দীপনের মোবাইলে চেষ্টা করলাম। ধরলো না।
সজ্জা শেষ করেই আবার দিলাম। ধরলো না। তারপর আবার। এবার ধরলো। বললো, ‘একটু ব্যস্ত আছি। এক বন্ধুর বাসায় এসেছি। তুমি তো আর আসবে না। কার্ড খেলে সময় টা কাটাই।’
‘না , আমি আসবো। ইনফেক্ট আমি রেডি । তুমি আস। বৃষ্টি হোক কিংবা নাই হোক। আস। ঐ খানেই আস। আসছো কিন্তু।’
‘না । তুমি এই ঝড়ে বের হয়ো না।’
‘আমি জানি না। আমি জানি আমি আসছি।’
‘না , তুমি কিন্তু আসছো না।’
আমি ফোনটা রাগ করে রেখে দিলাম।

সেটাই কি সবচেয়ে ভুল হলো? ভুল হবে কেনো। জীবনের ধাপে ধাপে আরও বড় ভুল করা থেকে বিরত থাকার জন্য সেটাই সবচেয়ে বড় উপহার আমার প্রতি জীবনে।

কিছুক্ষণ ভাবলাম। এখন আর রাগ ঠিক না। কেমন একটা অনুযোগ মনে । কার প্রতি? জানি না। মাকে একটা ভোলানা কথা বুঝিয়ে বের হযে পড়লাম। মেঘ সরে যেতে শুরু করেছে ততক্ষনে। পথটাতে শেষ বেলার ডুবন্ত ক্ষণের পূর্বসূর্যটা আলো ফেললো। যাহ! বৃষ্টি আর হচ্ছে না। হয়তো ভালোই হলো। কিন্তু এই যে ঘন্টা দুয়েকের একটা ফান করে গেলো তার বিচার কে করবে?
অবশ্য  ভীষন মনমাতানো একটা হিমেল হাওয়া বইছে। চুল উড়ছে। সাথে উড়ছে মন। মনটা এখন ভালোর দিকে। আমি জানি ও আসবে। ও এমনই। জানি বলেই তো দেহমনে ভালবেসেছি দীপনকে।

কিন্তু একি লেকের আগের রাস্তাটাতে পৌঁছাতেই আকাশ থেকে নেমে এলো ঝমঝম করে পানির ধারা। এত মেঘে বৃষ্টি নেই। অথচ এখন বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত। রোদটাও বেড়ে গেছে সাথে সাথে। রোদ বৃষ্টি। ছোটবেলায় রোদ বৃষ্টি হলেই চিৎকার করে গলা চড়াতামআমি আর নীলা আপু। বাঙ্গালীর চীর চেনা সেই প্রবাদ- রোদ বৃষ্টি , খেকশিয়ালের বিয়ে।
আজকালের ছেলে মেয়েরা কি এ কথা বলে ওঠে? দীপন আর আমার যে সন্তান হবে। টুকটুকে ফুটফুটে তাকে আমি শেখাবো। বলব আর আমার বেবি প্রশ্ন করবে, মা , খেকশিয়ালের আবার বিয়ে হয় নাকি?
আমার মা যেমন উত্তর দেয়নি। আমিও দেবো না।

বিনা মেঘের বৃষ্টিতে ভিজেই গেলাম। কপালের ফের। তাহলে সেই প্রথমেই বের হলে কি হতো? নিজের উপর বিরক্তি এলো খুব।

রিকশার হুট উঠিয়েও লাভ হচ্ছে না। বৃষ্টি এসে কামিজ সেলোয়ার সব কিছুতে আবাসন গড়তে শুরু করেছে।
টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। মুখটাতে পানির শীতল পরশ।

হাত দিয়ে মুখের পানি টুকু ছেড়ে ফেলতেই। একটা রিকশার টুং টুং আওয়াজ কানে এল। রিকশাটা সামনে। এক জোড়া যুুবক যুবতি। নিবির আলিঙ্গনে খুব কাছাকাছি। হাতদুটো ধরে হাতে। তারা ভিজছে। তারা খুনসুটি করছে। আর আমার মনটা ভাঙা কাচের মত চূর্ণ চূর্ণ হয়ে  যাচ্ছে ।

সামনের রিকশাটায় আর অন্য কেউ নয়। আমার দীপন।
দীপনের ঠোঁটটা মেয়েটার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি ঝুমঝুম করে তাদের মুখে এসে পড়ছে।
আর দেখা যায় না। এটাই আমার মত সহজ সরল এক মেয়ের জন্য অনেব বেশী। অনেক অসহ্যের। এর বেশেী সীমা নেই।

রিকশাটা কাছে এগিয়ে আসছে। আমি নিজের মুখটা আড়াল করে রাখি দুহাতে। বৃষ্টি আমার মুখ আর ছুঁতে পারছে না। আমার দৃষ্টিকেও ছুুঁতে পারছে না নষ্ট পুরুষটির নষ্টামি।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


17 Responses to বিনা মেঘের বৃষ্টি

You must be logged in to post a comment Login